অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
বিচারকের উপরে নানা ভাবে চাপ তৈরির চেষ্টা এর আগে পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছেন। কিন্তু সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে আইনজীবীদের প্রবল চাপ ও কটূক্তির ঝড় অগ্রাহ্য করে বিচারক কী ভাবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন, এ বার তারও সাক্ষী রইল রাজ্য।
ঘটনাস্থল সোমবারের আলিপুর আদালত। আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (২) হারাধন মুখোপাধ্যায় এ দিন তৃণমূল-সমর্থক আইনজীবীদের শাসানি-হুমকি অগ্রাহ্য করে সারদা মামলায় সিবিআইয়ের আবেদনে সাড়া দিলেন। আগের ভুল শুধরে এ দিন তিনি সিবিআইয়ের চার্জশিটে জুড়ে দিয়েছেন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ নম্বর ধারাটি। ফলে আগামী বৃহস্পতিবার পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের জামিনলাভের সম্ভাবনা অনেকটা কমে গেল বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ।
এবং অভিযোগ, এই কারণেই ধারাটির সংযোজন আটকাতে তৃণমূল-সমর্থক আইনজীবীরা যে কাণ্ড করলেন, তা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গোটা দেশেই কার্যত নজিরবিহীন। এ দিন যে ভাবে বিচারকের দিকে আঙুল তুলে সরাসরি ‘ঘুষ’ খাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে, তা দেখে আইনজীবীদের একাংশ রীতিমতো স্তম্ভিত। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের প্রশ্ন, “বিচারকই যদি নিরাপত্তা না পান, তবে বিচারপ্রার্থীর নিরাপত্তা কে দেবে?” সিবিআই সূত্রের ইঙ্গিত, পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা চলতে থাকলে সারদা-মামলা অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হতে পারে।
দুপুরে এজলাসের মধ্যে বিচারককে ঘেরাও করে ফেলেন বিক্ষোভকারী আইনজীবীরা। বিচারকের উদ্দেশে কটূক্তির ঝড় বইতে থাকে। এক সময়ে বিচারক বলে ওঠেন, “আপনাদের মধ্যে এক দল বাইরে গিয়ে চা খাচ্ছেন, অন্য দল ভিতরে চিৎকার করছেন! আবার বাইরের দল ঢুকছে, ভিতরের দল বেরিয়ে যাচ্ছে! আমি কিন্তু তখন থেকে ঠায় চেয়ারে বসে!” বিচারক এ-ও জানিয়ে দেন, প্রয়োজনে তিনি রাতভর বসে থাকতে তৈরি। তবে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরবেন না।
গত ১৬ জানুয়ারি মদনকে হাজির করার পরে সে দিন এক আইনজীবী হারাধনবাবুকে বলেছিলেন, “আপনি আলিপুর আদালতে বসে এ ভাবে নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পারবেন না।” সে দিন বিচারক চুপ করে ছিলেন। এ দিনও গোড়ার দিকে তিনি নীরব ছিলেন। কিন্তু ‘ঘুষ’-এর অভিযোগ শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বলেন, “আপনারা তো গোটা বিচার ব্যবস্থাকেই অপমান করছেন!”
আদালত-সূত্রের খবর, সারদা মামলায় গত ১৭ নভেম্বর আলিপুর কোর্টে সিবিআই যে চার্জশিট জমা দিয়েছিল, তাতে অন্যান্য ধারার সঙ্গে ছিল ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ নম্বর ধারাটিও। কিন্তু ১৮ নভেম্বর চার্জশিট গ্রহণের সময়ে সেটি বাদ পড়ে যায়। পরে বিচারক বলেন, “ভুল করে ধারাটি বাদ গিয়েছিল।”
এ দিকে চার্জশিট থেকে ৪০৯ বাদ পড়ায় সারদা-মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত, তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়ে গিয়েছেন। সেই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে মদন মিত্রের জামিনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন তাঁর কৌঁসুলিরা। আগামী ১২ তারিখ, বৃহস্পতিবার এই এজলাসে মদনবাবুকে তোলার কথা। তার আগে সিবিআইয়ের চার্জশিটে ৪০৯ নম্বর না-জুড়লে সৃঞ্জয়ের উদাহরণ দেখিয়ে মদনের জামিনের পথ অনেকটা সুগম হয়ে যেত।
সে কথা মাথায় রেখেই এ দিন তৃণমূল সমর্থক আইনজীবীরা প্রথমে বিচারককে অনুরোধ করেন, “স্যার, সিবিআইয়ের আবেদনের শুনানি চার দিন পরে করুন।” আইনজীবীদের একাংশের মতে, চার দিন পরে শুনানি হলে তার মধ্যে মদন মিত্রের জামিন হয়ে যাবে। তাই যে ভাবেই হোক, এ দিন বিচারককে ৪০৯ ধারা যুক্ত করা থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন তৃণমূল সমর্থক আইনজীবীরা।
ওই আইনজীবীরা এ দিন প্রথমে আদালতের কাজ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন। বিচারককে তাঁরা আবেদন করেন, গত শুক্রবার আলিপুরের বার অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রাক্তন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তাই শুনানি বন্ধ রাখা হোক। এ ধরনের আচমকা কর্মবিরতির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই কড়া বার্তা দিয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক আইনজীবীর মৃত্যুর পরে এ ভাবেই কর্মবিরতির ডাক দিলে তা অগ্রাহ্য করে হাইকোর্ট সচল রাখা হয়। তাই এ দিনও আদালতের কাজ হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল।
তবে আইনজীবী মহলেই একাংশের অভিযোগ, এ দিন শোকজ্ঞাপনের প্রশ্নটি ছিল গৌণ। মূলত সিবিআই-চার্জশিটে ৪০৯ নম্বর ধারার সংযোজন রুখতেই সোমবার তৃণমূল সমর্থক আইনজীবীরা শুনানি মুলতুবি রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিচারক তাতে বাদ সেধে বলেন, “ঠিক আছে, শুনানি হবে না। কিন্তু সিবিআইয়ের চার্জশিটে একটি ধারা ঢোকানোর ক্ষেত্রে ভুল হয়ে গিয়েছে। তা সংশোধনের জন্যই শুনানি ছিল। আমি সেই ভুল শুধরে দেব।”
এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা। ভিড়ের মধ্য থেকে এক আইনজীবী ‘ঘুষ’ নেওয়ার কথা বলতেই বিচারকও ফুঁসে ওঠেন। বক্তাকে লক্ষ্য করে বলেন, “আপনি আমাকে জানেন? চেনেন, যে আমাকে এ রকম বলছেন?” এই সময়ে তৃণমূল নেতা তথা আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে এসে পরিস্থিতি হাল্কা করার চেষ্টা করেন। তিনি ক্ষমাও চেয়ে নেন বিচারকের কাছে। ঠিক যেমন ১৬ জানুয়ারি তিনিই করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।
তবে এ দিন ক্ষমাপ্রার্থনাতেও বিচারকের ক্ষোভ কমেনি। বিক্ষোভকারীরাও অবরোধ তোলেননি। বরং তাঁরা এজলাসে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করতে থাকেন, এ ভাবে শোকপ্রস্তাব অবমাননা করে বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করছেন বিচারক। আইনজীবীরা দঙ্গল বেঁধে বিচারকের আসনের দিকে আঙুল তুলে নালিশ জানিয়েই যেতে থাকেন। সিবিআইয়ের কৌঁসুলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। এ দিন আদালতে মদনবাবু না থাকলেও বিক্ষোভের সময়ে তাঁর দুই ছেলেকে আদালত চত্বরে দেখা গিয়েছে।
বিচারকের অনড় মনোভাব বজায় থাকায় সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীরা পিছু হটেন। কয়েক জন প্রবীণ আইনজীবীর হস্তক্ষেপে সন্ধে পৌনে সাতটা নাগাদ অচলাবস্থা কাটতে শুরু করে। অন্যান্য মামলার শুনানি চালু হয়। কিছুক্ষণ বাদে বিচারক সিবিআইয়ের আবেদন মেনে সারদা মামলার চার্জশিটে ৪০৯ ধারা যুক্ত করেন। বিক্ষোভকারী আইনজীবীরা তখন দাবি তোলেন, নির্দেশে লেখা হোক যে, প্রক্রিয়াটি আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সম্পন্ন করেছে। বিচারক তা মেনে নেন। পরে বিক্ষোভকারী আইনজীবীদের নেতা বৈশ্বানরবাবু বলেন, “নিজের নির্দেশ যে কেউ এ ভাবে পরিবর্তন করতে পারেন, তা আগে কখনও দেখিনি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy