Advertisement
E-Paper

‘মানি’ মিত্রের জামিন অধরাই

ছিলেন মদন, হলেন ‘মানি!’ মিত্র পদবিটি অবশ্য একই থাকল! বুধবার আলিপুর আদালতে সারদা-কাণ্ডে ধৃত পরিবহণমন্ত্রীর এ হেন নতুন নামকরণ শোনা গেল সিবিআইয়ের কৌঁসুলির মুখে। মদনবাবুকে যিনি ‘মানি মিত্র’ বলে সম্বোধন করলেন। এখানে ‘মানি’ বলতে তিনি যে টাকাকে বোঝাচ্ছেন, তা-ও বলার অপেক্ষা থাকল না।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৬

ছিলেন মদন, হলেন ‘মানি!’ মিত্র পদবিটি অবশ্য একই থাকল!

বুধবার আলিপুর আদালতে সারদা-কাণ্ডে ধৃত পরিবহণমন্ত্রীর এ হেন নতুন নামকরণ শোনা গেল সিবিআইয়ের কৌঁসুলির মুখে। মদনবাবুকে যিনি ‘মানি মিত্র’ বলে সম্বোধন করলেন। এখানে ‘মানি’ বলতে তিনি যে টাকাকে বোঝাচ্ছেন, তা-ও বলার অপেক্ষা থাকল না।

এ দিন সারদা কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত মামলায় সিবিআইয়ের হয়ে সওয়াল করতে উঠেছিলেন বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি কে রাঘবচারুলু। গোড়াতেই পরিবহণমন্ত্রীর নাম করে তিনি ছুড়ে দেন প্রশ্ন “উনি কে? ছিলেন মদন মিত্র, হয়েছেন মানি মিত্র।” রূপান্তরের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। “উনি গরিবের টাকা মেরে মানি মিত্র হয়েছেন। এবং এটা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ!” তোপ দাগেন সিবিআই-কৌঁসুলি।

সারদা রিয়েলটি মামলায় মদনবাবুর জামিনের আর্জিও এ দিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। মামলাটিতে সিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা সংযোজনের প্রশ্নে আলিপুর কোর্ট তোলপাড় হয়েছে। ৪০৯ নম্বর যাতে যুক্ত করা না-যায়, সে জন্য সোমবার সেখানে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন তৃণমূলপন্থী এক দল আইনজীবী। অভিযোগ, ধারাটি জুড়লে পরিবহণমন্ত্রীর জামিন লাভ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বুঝেই তাঁদের এ হেন আচরণ। বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সে দিন উল্লিখিত মামলায় ৪০৯ যুক্ত করেন। কিন্তু তার আগে প্রতিবাদীরা বিচারকের উদ্দেশে যে ভাষা প্রয়োগ করেছেন এবং যে ভাবে প্রায় চার ঘণ্টা বিচার প্রক্রিয়া স্তব্ধ করে রেখেছেন, তাতে সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে।

এবং ৪০৯ যুক্ত হওয়ার জেরেই এ দিন জেলা দায়রা বিচারকের এজলাসে মদনবাবুর জামিন-আর্জি নাকচ হয়েছে বলে মনে করছেন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা। মদনবাবু অবশ্য এ দিন আদালতে ছিলেন না। শুনানির আগেই জেলের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়।

আলিপুরের জেলা দায়রা বিচারক সমরেশপ্রসাদ চৌধুরীর এজলাসে গত বৃহস্পতিবার মদনবাবুর তরফে জামিনের আবেদন করেছিলেন তাঁর কৌঁসুলি। প্রসঙ্গত, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওই আদালতেই জামিন পেয়েছেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। কিন্তু এ দিন রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবুর জামিন-আর্জি খারিজ করে বিচারক চৌধুরী বলেছেন, কেস ডায়েরিতে ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় সারদার আমানতকারী ও এজেন্টরা তাঁদের বয়ানে আবেদনকারীর (মদন মিত্র) জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন। তাই আবেদনকারীর সারদা-কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। “এই মুহূর্তে কাউকে জামিন দিলে বৃহত্তর অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও মানি ট্রেল (টাকার চোরাস্রোত) খুঁজে বার করার তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে” জানিয়ে দেন বিচারক।

রায়ের আগে মদনবাবুর হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়। যিনি ৪ তারিখে সৃঞ্জয় বসুর হয়েও দাঁড়িয়েছিলেন। মিলনবাবু আদালতকে বলেন, গ্রেফতারের বাষট্টি দিন বাদেও সিবিআই মদনবাবুর বিরুদ্ধে কোনও তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। মদনবাবুর প্রভাবে সারদায় টাকা রেখেছেন, এমন এক জনও এজেন্ট বা আমানতকারীকে পাওয়া যায়নি বলে তাঁর দাবি। সজ্জন অগ্রবাল এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন, সে প্রশ্নও তিনি তোলেন। বিচারক বলেন, “সিবিআই জানিয়েছে, বয়স হওয়ায় (সিনিয়র সিটিজেন) সজ্জনকে গ্রেফতার করা হয়নি।” শুনে মিলনবাবুর মন্তব্য, “মদন মিত্রের বয়স ৬১। রেলের নিয়ম অনুযায়ী, তিনিও সিনিয়র সিটিজেন। উপরন্তু উনি জনপ্রতিনিধিও বটে।” মিলনবাবুর বক্তব্য, “মদন মিত্র কাউকে টাকা রাখতে বলেননি। তাঁর কাছে কেউ টাকা রাখেনি। সিবিআই নতুন কিছু বলছে না। নিয়ামক সংস্থাগুলোর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না।”

বস্তুত গত দু’মাস যাবৎ মদনবাবুর আইনজীবীরা বারবার এই যুক্তি-জালই সাজিয়ে আসছেন। যার পাল্টা হিসেবে এ দিন আদালতে সিবিআই-কৌঁসুলির দাবি, “সারদা-ঘনিষ্ঠ অনেকে জানিয়েছেন, মন্ত্রীকে দেখেই আমানতকারীরা সারদায় টাকা রেখেছেন। তাঁদের বয়ানে যা উঠে আসছে, তা যথেষ্ট ভয়াবহ।” পাশাপাশি তাঁর পর্যবেক্ষণ, “সারদা বাজার থেকে ২৫৪৯ কোটি টাকা যে তুলতে পারল, তার পিছনে মদনবাবুর মতো মুখের যথেষ্ট অবদান। এঁরাই এজেন্টদের অভয় দিয়েছেন আমি আছি, তোমরা এগিয়ে চলো!”

পরিবহণমন্ত্রী কী ভাবে সারদার কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, তার বিস্তারিত ‘বিবরণ’ও শোনা গিয়েছে সিবিআই-কৌঁসুলির মুখে। কী রকম?

সওয়ালে তাঁর দাবি, মদনবাবু সারদার কারবারে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। “দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের বিধায়ক ছিলেন মদন। ওই তল্লাট থেকেই সারদার উত্থান। দু’পক্ষের যোগাযোগের সূচনাও। পরে অর্থ লগ্নির কারবার শুরু হলে মদনবাবু সেখানেও নিজের প্রভাব বিস্তার করেন” বলেন রাঘবচারুলু। তাঁর দাবি, মদনবাবু সারদার পাশে থাকায় আমানতকারীরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। মদনবাবু নিজেও সারদার সভায় গিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাঁর ভাবমূর্তিকে সামনে রেখে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে সারদা টাকা তুলেছিল। আদালতে ছবি ও নথিপত্র পেশ করে সিবিআই-কৌঁসুলির মন্তব্য, “একশো টাকা আমানত পেলে এজেন্টকে সারদা দিত তিরিশ টাকা! এজেন্ট লোভে পড়ে আরও শিকার খুঁজত। নতুন আমানতের টাকা দিয়ে পুরনো আমানতকারীর পাওনা মেটানো হতো। এটা বেআইনি।”

এই সব অভিযোগকে প্রেক্ষাপটে রেখে মদনের জামিনের বিরোধিতা করেন সিবিআই-কৌঁসুলি। তাঁর যুক্তি,সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সারদা- কাণ্ডের নেপথ্যে থাকা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ ও টাকা লোপাটের ঘটনা খতিয়ে দেখতে। সেই সূত্রেই প্রভাবশালীদের ভূমিকা যাচাই করা হচ্ছে। “এটা আর্থিক অপরাধের মামলা। সব সময় প্রত্যক্ষ প্রমাণ না-ও মিলতে পারে। তদন্ত এগোচ্ছে। এই পর্যায়ে মদনবাবুর মতো প্রভাবশালীকে জামিন দিলে তদন্তের ক্ষতি হবে।” সওয়াল করেন রাঘবচারুলু।

আইনজীবী মহলের বড় অংশের ধারণা, মন্ত্রীর জামিনের আবেদন খারিজ করতে গিয়ে এ দিন বিচারক সিবিআই-কৌঁসুলির যুক্তি কার্যত মেনে নিয়েছেন। তবে সিবিআই-কৌঁসুলির একটি মন্তব্যের জেরে আদালতকে এ দিন খানিক বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয়েছে। মদন মিত্রের ‘প্রভাবের’ দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রাঘবচারুলু আচমকা বলে বসেন, “জেলে মদ্যপ অবস্থাতেও ধরা পড়েছেন মন্ত্রী।” যা শুনে মদনবাবুর কৌঁসুলিরা হইচই করে ওঠেন। “কী প্রমাণ রয়েছে?” চিৎকার করে প্রশ্ন করতে থাকেন তাঁরা।

শেষমেশ বিচারক ওঁদের চুপ করিয়ে সিবিআই-কৌঁসুলিকে বলেন প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে।

madan mitra money mitra cbi saradha scam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy