ত্রাণশিবিরে একটা শব্দ এখন প্রায়ই শোনা যায়— নব্য ভারতীয়। ‘‘আগে ছিলাম ছিটমহলের বাসিন্দা। নাগরিক অধিকারের অর্ধেকও ভাল মতো দেখতে পাইনি। এখন পুরোপুরি দেশের নাগরিক,’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন এক বয়স্ক মানুষ।
তিনিই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন আর এক সমস্যার দিকে। পড়াশোনা। এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা কর্মসংস্থানেরও।
পড়াশোনা নিয়ে কী সমস্যার মুখে পড়ছে পড়ুয়ারা? ছিটমহলে থাকাকালীন অনেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক (ও বাংলায় যাকে ইন্টারমিডিয়েট বলা হয় এখন) পরীক্ষা দিয়েছে বাংলাদেশের বোর্ড থেকে। তার পরেও এ দেশে এসে পড়তে হচ্ছে এক বা দু’ক্লাস নিচুতে। অর্থাৎ মাধ্যমিক দিয়ে এসেছে এমন ছাত্রকে ভর্তি হতে হচ্ছে নবম বা দশম শ্রেণিতে। ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে এসেছে এমন পড়ুয়াকে শুরু করতে হচ্ছে একাদশ শ্রেণি থেকে। এমনিতেই বাংলাদেশে নবম শ্রেণি থেকেই ভাগ হয়ে যায় কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগ। এ পার বাংলায় যে ভাগাভাগিটা হয় একাদশ শ্রেণি থেকে। ফলে যাকে মাধ্যমিক পাশ করে এসে নবম বা দশম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হচ্ছে, তাকে পড়তে হচ্ছে বাংলা-ইংরেজি-সহ যাবতীয় বিষয়।
এমনই দুই ছাত্র নবীন ও তাপস রায়। তারা বাংলাদেশের কলা বিভাগের ছাত্র ছিল। এ বারে হলদিবাড়ি হাইস্কুলে তাদের ভর্তি হতে হয়েছে নবম শ্রেণিতে। কল্যাণ রায় আবার ইন্টারমিডিয়েটের টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। তাকে ভর্তি হতে হয়েছে এগারো ক্লাসে। কল্যাণ এখন চাইছে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে। মার্চেই সেখানে আইএ ফাইনাল। কল্যাণের বক্তব্য, “আমরা যারা এরকম অবস্থায় আছি, তাদের বাংলাদেশে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। না হলে আমরা চার বছর পিছিয়ে পড়বো।”
দ্বিতীয় সমস্যা কাজের। পরিবার পিছু একটা মাত্র জব কার্ড দিয়ে অনেকেই ক্ষোভ জানিয়েছেন। একশো দিনের কাজের পাওনাগন্ডা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে। অনেকেই বলছেন, ‘‘ও বাংলার ছিটমহলে থাকার সময় সে দেশে খাওয়া-পরার অভাব ছিল না। কাজও জুটতো। এখানে আসার পর এখনও পেট ভরা খাওয়া মিলছে না।’’ ফলে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন অনেক ‘নব্য ভারতীয়’ই।
হাতে মেলেনি ভোটার পরিচয়পত্র-ও। নেই তফসিলি জাতি, উপজাতি সংশাপত্র। ক্যাম্পের বাসিন্দা নিমাই রায়, সন্তরাম রায়-রা বলেন, “যারা বাংলাদেশ থেকে মাধ্যমিক পাশ করে এসেছে, তারা কোথাওই চাকরির আবেদন করতে পারছেন না। আর যারা ততটা পড়াশোনা করেনি, তাদের অবস্থা তো আরও করুণ।’’
নব্য ভারতীয়দের মুখপাত্র হরি বর্মন বলেন, “আমরা বাংলাদেশে থাকতে জেনেছিলাম যে আমাদের পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন দেওয়া হবে। এখানে এসে আমরা তা পাচ্ছি না।’’ তাঁরা দাবি তুলেছেন, ‘‘আমাদের জীবনধারণের জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় আমরা আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হব।” কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “ওদের বিষয়গুলি আমি শুনেছি।” এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
তা হলে কি নব্য ভারতীয়দের জন্য সবই আঁধার? শিবিরে ঘুরে অবশ্য আলোর রেখাও দেখা গেল। মেয়েরা খোলা গলায় বললেন, ভারতে এসে তাঁরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছেন। এবং নিশ্চিন্তও। কারণ, আইনগত কোনও সমস্যা হলে দ্রুত প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছেন তাঁরা। ও বাংলায় যা সহজে মিলত না।
এই আলোর রেখা ধরেই বাঁচছেন ওঁরা। স্বপ্ন দেখছেন, বাকি সমস্যাগুলোও মিটে যাবে এক দিন।