জেলার পুলিশ সুপারকে চিঠি লিখেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিহতের স্ত্রী। তার পরেও প্রায় দু’বছর ধরে জেলার পুলিশ তার টিকিও খুঁজে পায়নি। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং জেলা পুলিশের যৌথ অভিযান হতেই মিলল ফল। হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন দুবরাজপুরের এসআই অমিত চক্রবর্তী খুনে ফেরার সেই তৃণমূল নেতা আলিম শেখ।
সোমবার দুপুরে তার নিজের গ্রাম সালুঞ্চিতেই খোঁজ মিলল দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির ওই পূর্ত কর্মাধ্যক্ষের। যার পরে নিহতের স্ত্রী পুতুলদেবীর দাবি, স্বামীর খুনে ওই তৃণমূল অভিযুক্তকে ধরার জন্য এক সপ্তাহ আগেই নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছিলেন। কমিশনের চাপেই এত দিন ধরে ‘ফেরার’ সেই নেতাকে খুঁজে পেল বীরভূম জেলা পুলিশ। বিরোধীদের যদিও বরাবরের অভিযোগ ছিল, শাসকদলের নেতা হওয়ার কারণেই আলিমকে ধরেনি পুলিশ। এ দিনের গ্রেফতারি তাদের সেই অভিযোগকেই প্রমাণ করল বলে বিরোধীদের দাবি।
বিরোধীরা এমন অভিযোগ করলেও ওই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে— এই তথ্যটুকুর বাইরে আর কিছু বলতে চাননি জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। তবে জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘এই অভিযোগ ঠিক নয়। আলিমকে ধরতে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তখন সফল হইনি। এ বার হলাম।’’ আজ, মঙ্গলবার ধৃত তৃণমূল নেতাকে দুবরাজপুর আদালতে হাজির করানো হবে।
২০১৪ সালের গত ৩ জুন দুবরাজপুরের যশপুর পঞ্চায়েতের গোপালপুর গ্রামে পুকুর সংস্কার করাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও সিপিএমের সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পোঁছে ওই সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমার আঘাতে মারাত্মক জখম হন দুবরাজপুর থানার তৎকালীন টাউনবাবু অমিত চক্রবর্তী। দুর্গাপুরের দ্য মিশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অমিতবাবুর ৫৫ দিনের লড়াই শেষ হয় ২৮ জুলাই।
ওই ঘটনায় পুলিশ আগে ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। অমিতবাবুর মৃত্যুর পরে খুনের মামলাও রুজু হয়। অভিযুক্তদের তালিকায় নাম ছিল শাসকদলের যশপুরের অঞ্চল সভাপতি, দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আলিম শেখ-সহ এলাকার প্রায় ৩০জন কর্মী-সমর্থক। অভিযুক্তদের তালিকায় নাম ছিল সিপিএমের জোনাল নেতা সৈয়দ মকতুল হোসেন-সহ বেশ কিছু সিপিএম কর্মী-সমর্থকদেরও। কিন্তু গ্রেফতার হয়েছিলেন মাত্র ১৭ জন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ৫০ জনের বিরুদ্ধেই চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। পুলিশ গত দেড় বছরে আর কাউকেই ধরতে পারেনি। অধরাদের মধ্যে ওই নেতা শেখ আলিম-সহ শাসকদলের নেতা কর্মী-সমর্থকদের সংখ্যাই ছিল সিংহভাগ। বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশ খুনে কোনও ভাবেই যেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ধরা না পড়ে, এমন একটা চাপ শাসকদলের পক্ষ থেকে ছিল। ওই মামলায় এ বছরের গোড়া থেকেই নানা সমালোচনার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত মামলার চার্জ গঠন হওয়ার পরে শেখ দুলাল নামে এক ফেরার তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
যদিও অমিত জখম হওয়ার পর থেকেই জেলায় পুলিশের একাংশের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। পুলিশের নিচুতলায় অনেকের মনোবলে চিড়ও ধরে। সেই ক্ষোভ আরও বেড়ে যায় ওই তরুণ পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর পরে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, এর পরই তৃণমূল নেতৃত্বের কাছ থেকে আলিমকে ধরার সবুজ সংঙ্কেত পায় পুলিশ। তৎকালীন জেলার এসপি অলোক রাজোরিয়ার নেতৃত্বে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সালুঞ্চি গ্রামে পুলিশি অভিযান চলে। ফেরার অভিযুক্তদের কাউকেই অবশ্য ধরতে পারেনি পুলিশ। এর পরে একাধিক পুলিশি অভিযান অসফল হয়।
পুলিশের একটি অংশের দাবি, দাপুটে তৃণমূল নেতা হওয়ায় এলাকায় জনসমর্থনের জন্য যে কোনও অভিযানের খবরই আগাম পৌঁছে যেত আলিমের কাছে। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিলেও তা মানতে চাননি আলিম। ২০১৪ সালের পরে বিষয়টি থিতিয়ে যায়। যদিও অস্বস্তি কাটেনি। এমনকী, আড়ালে থাকলেও যশপুর পঞ্চায়েত এলাকার কর্তৃত্ব প্রথম দিকে আলিমের হাতেই ছিল। তা নিয়ে নেতৃত্বের সঙ্গে বিভাজনও তৈরি হয়। কিন্তু সমস্যা না মিটলে বিধানসভা ভোটে সমস্যা বাড়তে পারে এই কারণে দলীয় সূত্রে আলিমকে নিয়ে ভাবনাও শুরু হয় বলে খবর। এমনই এক আবহে হঠাৎ করেই চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি চুপিচুপি আলিম-সহ ৩৬ জন অভিযুক্তের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন আদালতে জমা দেন সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
রণজিৎবাবুর দাবি ছিল, এক জনের ছোড়া বোমায় আহত হয়ে পরে মৃত্যু হয় অমিতের। অথচ পুলিশ ৫০ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেছে। এলাকা থেকে পাওয়া আবেদন দেখে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে এবং নিজে তদন্ত করে তাঁর মনে হয়েছে, ওই ৩৬ জনই নিরপরাধ। সরকার পক্ষের ওই আর্জির কথা তা জানাজানি হতেই ক্ষোভ ছড়ায় পুলিশের একংশের মধ্যে। খোদ সরকারি আইনজীবীই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার সওয়াল করেছেন শুনে স্তম্ভিত হন নিহতের পরিবারও। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, শাসকদলকে সুবিধা দিতেই মামলা প্রত্যাহারের ওই আবেদন করা হয়েছিল। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে শেষমেশ ওই বিতর্কিত আর্জি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় রাজ্য সরকার। পুলিশ অফিসার খুন হওয়ার পরেও সরকারি আইনজীবী যে ভূমিকা নিচ্ছিলেন, তা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুতুলদেবী। আইনজীবী বদলের দাবি জানিয়ে চিঠি দেন জেলাশাসককেও। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত মামলা থেকে সরে দাঁড়ান রণজিৎবাবু। কিন্তু উত্তাপ থেকেই যায় বাকি অভিযুক্তদের ধরার বিষয় নিয়ে। শেষমেশে চার্জ গঠনের পরেই দুলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ বার গ্রেফতার হলেন আলিম।
পুলিশের মতোই অভিযোগ মানতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্বও। এমনকী, অমিত হত্যায় আলিম জড়িত নয় বলে দাবি করছেন তৃণমূলের দুবরাজপুর ব্লক সভাপতি ভোলা মিত্র। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘অভিযোগ ছিল, পুলিশ ধরেছে। আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছে পুলিশ। তবে, আমি জানি আলিম ওই ঘটনায় জড়িত নয়।’’ গোটা পর্বে পুলিশের ভূমিকায় যদিও সন্তুষ্ট নন অমিতের পরিবার। আলিম কেন এত দিন ধরা পড়েনি, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পুতুলদেবীও। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও মূল অভিযুক্ত ধরা পড়েনি। অথচ নির্বাচন কমিশনকে জানানোর পরেই নিজের গ্রাম থেকে সে গ্রেফতার হয়ে গেল!’’ নির্বাচন কমিশনের চাপেই এমনটা হয়েছে বলে মত অমিতের পরিবারের। আর নিহতের দিদি, চুঁচুড়ার রথতলার বাসিন্দা অমিতা বলছেন, ‘‘দাদাকে তো ফেরত পাব না। কিন্তু আমার দাদার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তারা সাজা পেলে মনের দিক থেকে শান্তি পাব। দেরিতে হলেও অভিযুক্ত ধরা পড়েছে জেনে ভাল লাগছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy