ভুল স্বীকারে এত দিন তাঁর পূর্বসূরির ব্যুৎপত্তির কথা জানতেন রাজ্যবাসী। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের মুখে ভুলের স্বীকারোক্তি শোনা গেল বিধানসভায়!
অতীতের ভুল স্বীকার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই নিয়ে তাঁর বোধোদয়ের কথা শোনালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বললেন, ‘‘আমিও আগে সিবিআই চাইতাম। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল!’’ ঘটনাচক্রে, সিবিআইয়ের আইনজীবীর প্রবল বিরোধিতায় সারদা-কাণ্ডে মমতা-সরকারের মন্ত্রী মদন মিত্রের জামিনের আর্জি ফের খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই এমন স্বীকারোক্তি শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রীর মুখে!
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ আক্রান্ত বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে মঙ্গলবার বিধানসভার জিরো আওয়ারে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন। জবাব দিতে গিয়ে নিজেই সিবিআইয়ের প্রসঙ্গ টেনে ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী!
সিবিআই যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হাতিয়ার, বহু ঘটনায় তারা প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পারেনি— সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই সে কথা বলে আসছেন মমতা। কিন্তু যখনই মমতা সিবিআইকে আক্রমণ করেছেন, তাদের সল্টলেকের দফতরের সামনে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে তৃণমূল, প্রত্যেক বারই পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে বিরোধী নেত্রী হিসাবে তিনি ঘনঘন সিবিআই তদন্তের দাবি করতেন কেন? এই প্রশ্নের কোনও জুতসই জবাব এত দিন তৃণমূল শিবির থেকে আসেনি। এ বার বিধানসভা ভোটের বছরখানেক আগে বিরোধীদের ওই আক্রমণ বন্ধ করতে নিজেই ভুল স্বীকার করার কৌশল নিলেন তৃণমূল নেত্রী।
ভুল ভাঙল কী করে, তার ব্যাখ্যাও এ দিন দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘সিঙ্গুর থেকে ধারণা ভাঙল। কী করেছে সিবিআই? কোন কেসটার সমাধান করেছে? তাপসী মালিকের ঘটনা সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছিল। কী করেছে ওরা?’’ মুখ্যমন্ত্রীর আরও তোপ, ‘‘নেতাই, নোবেল চুরি— কী করতে পেরেছে ওরা? কিনারা করতে পেরেছে? ১৪টা কেস দিয়েছিলাম ওদের, ওয়াকফ দিয়েছিলাম। একটারও কিনারা করতে পারল না!’’ নন্দীগ্রাম তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মমতা বলেন, ‘‘ওখানে নিচু তলার কয়েক জনকে কেন অভিযুক্ত করবে (সিবিআই)? উপর তলার লোকেদের কেন ছাড়া হবে?’’ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে মমতার সরাসরি অভিযোগ, ‘‘সিবিআই যেটা রাজনৈতিক ভাবে করা উচিত বলে মনে করবে, সেটাই করবে। পুরো মার্কেটিং চলছে, মার্কেটিং!’’
সিবিআই নিয়ে মমতার এই ‘ভুল স্বীকারে’র কয়েক ঘণ্টা আগেই সোমবার রাতে কলকাতার নগর দায়রা আদালত সারদা মামলায় অভিযুক্ত মন্ত্রী মদনের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। জামিনের আর্জির তীব্র বিরোধিতা করে আদালতে সিবিআইয়ের প্রশ্ন ছিল, ১৬৫ দিনের মধ্যে জেলে আর ক’দিন ছিলেন মন্ত্রী? বন্দিজীবনের অধিকাংশ সময়ই তো তিনি হাসপাতালে! মদনের জামিনের আর্জি খারিজ হওয়ার সিবিআই সম্পর্কে উষ্মাই এ দিন তাঁর বোধোদয়ের নেপথ্য কারণ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিরোধী শিবিরে এবং দলের মধ্যেও।
তবে মদন-কাণ্ড সাম্প্রতিক উপলক্ষ হলেও মুখ্যমন্ত্রীর সিবিআই-তত্ত্বের পিছনে আরও রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সারদা তদন্তের গতি আপাতত স্তিমিত ঠিকই। কিন্তু মমতা বিলক্ষণ জানেন, ওই তদন্তে সিবিআই আরও এগোলে এবং তাঁর দলের মাথাদের টান পড়লে বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের বিড়ম্বনাই বাড়বে। তাই রাজনৈতিক ভাবে সিবিআই-কে আক্রমণের রাস্তায় যাওয়াই শ্রেয় বলে তাঁর মনে হয়েছে। কিন্তু তাঁর ওই আক্রমণকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার পথে বাধা ছিল তাঁর নিজেরই অতীত। এ বার তিনি অতীতের সিবিআই-দাবি ভুল ছিল বলে স্বীকার করে নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে আরও সরব হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করলেন। যাতে বিরোধীরা আর তাঁর অতীত নিয়ে বিশেষ নিশানা করতে না পারে!
বিরোধীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘উনি নাকি বুঝতে পেরেছেন, সিবিআই চেয়ে ভুল করেছেন। পুরোটা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয় না!’’ রানাঘাটে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনার তদন্ত সিবিআইকে দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে মমতা কথা বলেছিলেন কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যবাবু। কংগ্রেসের মানসবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সিবিআই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ এখন নতুন বোধোদয় হয়েছে! সরকারি সংস্থা সম্পর্কে আমাদের দল আগে যা মনে করত, এখনও তা-ই মনে করে। কিন্তু ওঁর নতুন বোধোদয়ের কথা শুনলাম।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, বিপাকে পড়ে সিবিআই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এখন অন্য সুরে কথা বলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অতীতের ভুলের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি এখন যা বলছেন এবং যা করছেন, তা-ও সব ভুল। যত দ্রুত এই সব ভুল নিয়ে তাঁর বোঝোদয় হয়, রাজ্যবাসীর তত মঙ্গল!’’
শাসক দলের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ভুল স্বীকার আসলে বহু ভাবনা-চিন্তার পরে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। বিধানসভা ভোটের আগে সারদা-কাণ্ডের মোকাবিলায় সম্ভাব্য পথ তৈরি করে রাখতেই তাঁকে এমন কথা বলতে হয়েছে। পাশাপাশিই শাসক দলের এক নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশ আক্রান্ত হচ্ছে। বিরোধীরা বলছে, নিজের দলের লোকজনকে বাঁচাতে গিয়ে আমরা পুলিশের মনোবল ভেঙে দিচ্ছি। এই অবস্থায় সিবিআইকে তাচ্ছিল্য করে এবং রানাঘাটে দুষ্কৃতীদের সিআইডি-র হাতে ধরা পড়ার উদাহরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর বাহিনী যথেষ্ট দক্ষ।’’
রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের একাংশেরও মত, সিবিআই নিয়ে ভুল কবুল করার জমি ধীরে ধীরে তৈরি করেই ফেলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিছু দিন আগে তিনি বলেছিলেন, রানাঘাট-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তভার না নিলেও সিআইডি প্রধান অভিযুক্ত-সহ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে দেখিয়েছে। আবার ২০১১-র নেতাই গণহত্যার ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই সিবিআই তদন্তভার নিলেও প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে অভিযুক্ত সিপিএম নেতা-কর্মীদের ধরে এনেছে রাজ্য পুলিশই। নন্দীগ্রাম মামলায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও কয়েক জন অফিসারকে মমতার সরকার অভিযুক্ত হিসাবে দেখাতে চাইলেও সিবিআই সে পথে হাঁটেনি। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, বিরোধী নেত্রী মমতা বিভিন্ন ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে বলতেন, সিপিএমের লোক অভিযুক্ত যেখানে, সেখানে বাম সরকারের পুলিশ কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারে না। এখন তাঁর দল ও সরকার যখন সারদা কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত, তখন সেই সিবিআই-কেই তিনি নিরপেক্ষ তদন্তকারী সংস্থা মনে করছেন না! ওই অফিসারের কথায়, ‘‘এই কথাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এ বার অন্য পথে হাঁটলেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
অন্য পথের যাত্রী সেই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল, ‘‘কথায় কথায় আপনারা (বিরোধীরা) সিবিআইয়ের দাবি তোলেন। বাজি ফাটলেও সিবিআই চান!’’ ঠিক যেমন দু’দশকেরও বেশি সময় বিরোধী নেত্রী কথায় কথায় সিবিআই চাইলে শাসক বাম নেতারা বলতেন, গৃহস্থের বাড়িতে সিঁধেল চোর ঢুকলেও মমতা সিবিআই চাইতে পারেন! এখন মমতা মেনে নিলেন, সে সব চাওয়াই ভুল ছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy