Advertisement
E-Paper

তোলাবাজি বরদাস্ত নয়, কড়া সুর মমতার

তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের গোড়া থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে চলেছেন, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি-সহ কোনও রকম দুর্নীতি আর বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু তাতেও যেন বিশেষ কাজ হচ্ছিল না। প্রায় প্রতিদিনই দলের কিছু জনপ্রতিনিধি ও নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছিল তাঁর কাছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০৪:৪৬
গ্রেফতারির পর। বিধাননগর উত্তর থানায় তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।  মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

গ্রেফতারির পর। বিধাননগর উত্তর থানায় তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের গোড়া থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে চলেছেন, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি-সহ কোনও রকম দুর্নীতি আর বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু তাতেও যেন বিশেষ কাজ হচ্ছিল না। প্রায় প্রতিদিনই দলের কিছু জনপ্রতিনিধি ও নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছিল তাঁর কাছে। আর কালক্ষেপ না করে কড়া পদক্ষেপ করলেন নেত্রী। তোলা আদায়ের অভিযোগে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হল সল্টলেক পুরসভার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই এই গ্রেফতার বলে দল ও প্রশাসন সূত্রের খবর।

তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের মতে, অনিন্দ্যকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আসলে দলের সব স্তরের নেতা ও জনপ্রতিনিধিকেই স্পষ্ট বার্তা দিলেন দিদি। বুঝিয়ে দিলেন, দলের নাম করে কোনও রকম অনিয়ম বা দুর্নীতি মানা হবে না। বরং এমন হলে কড়া ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। অনিন্দ্যর গ্রেফতারি প্রসঙ্গে এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি এ সব টলারেট করব না।’’

অভিযোগ, অনিন্দ্য ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাড়ির মালিকের কাছ থেকে তোলা হিসেবে মোটা টাকা দাবি করেছিলেন। সূত্রের খবর, ওই ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচিত। অনিন্দ্যর টাকা চাওয়ার ঘটনাটি দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি ভাবে রাজ্য সরকারের কানে তোলা হয়। সে খবর, কোনও ভাবে মমতার কানেও যায়। তবে এই ব্যক্তি পুলিশে কোনও অভিযোগ করেননি। পুলিশে অভিযোগ করেন সন্তোষ লোধ নামে ৪১ নম্বর ওয়ার্ডেরই অন্য এক বাসিন্দা, যাঁর কাছেও বাড়ি সংস্কারের জন্য অনিন্দ্য তোলা চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই এ দিন গ্রেফতার হন কাউন্সিলর।

দলের এক নেতার কথায়, ‘‘এটা ঠিক যে অনিন্দ্য একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। টাকা তুলতে তুলতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। ফলে যাঁকে হুমকি দিয়ে টাকা চাইছেন, তিনি যে অনিন্দ্যর চেয়েও বেশি ‘প্রভাবশালী’ হতে পারেন, তা আঁচ করতে পারেননি!’’

ঘটনা হল, সরকারে তৃণমূলের প্রথম ইনিংসেই দুর্নীতি ও তোলাবাজির গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ উঠেছে। বসতবাড়ি থেকে কারখানা— যে কোনও ধরনের নির্মাণকাজের জন্য ইট-বালি-সিমেন্ট কেনাকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট রাজের দাপট মাত্রা ছাড়িয়েছিল। শাসক দলের বড়-মেজো-ছোট স্তরের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের জুলুমবাজির দাপটে ব্যবসা গুটিয়ে রাজ্য ছাড়ার অভিযোগও উঠেছে। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সব দেখেশুনেও চোখ-কান বন্ধই রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, ২০১১ সালে দল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৩-তেই পঞ্চায়েত ভোটে নামতে হয়। তার পর ২০১৪-য় লোকসভা, ’১৫-য় পুরসভা এবং এ বছর বিধানসভার ভোট হয়েছে। সে সব সামলাতে গিয়ে এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া হওয়া তেমন সুযোগ মেলেনি। তা ছাড়া ভোটের সময় এ সব করতে গেলে বিক্ষুব্ধ রাজনীতি মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কাও ছিল।

এ বারের বিধানসভা ভোটে আরও বেশি শক্তি নিয়ে সরকারে ফিরেছেন মমতা। ফলে দলের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে আর কালক্ষেপ করতে চাইছেন না তিনি। সূত্রের খবর, সম্প্রতি দলের ঘনিষ্ঠ মহলে নেত্রী বলেছেন, কলকাতা ও শহরাঞ্চলের কিছু কাউন্সিলর কী পরিমাণ দৌরাত্ম্য চালাচ্ছেন, তা ঘরে বসেই টের পাচ্ছেন তিনি! রোজ সকালে তাঁর কাছে অন্তত চার থেকে পাঁচটা অভিযোগ আসে কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে। এবং তার বারো আনাই প্রোমোটারি চক্র সংক্রান্ত। কেউ পুরনো বাড়ি প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ধমকাচ্ছেন, কেউ জমি বেচে দেওয়ার জন্য। এমনকী, নিজে জমি কিনে কেউ বাড়ি করতে গেলেও তাঁকে কাউন্সিলরের হয়ে ধমকানো হচ্ছে। আক্ষেপের সুরে মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছেন, এ সব করেও এঁরা কী করে ভোটে জিতে যায়, সেটাই আশ্চর্যের! তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেন, এ ধরনের কয়েক জন কাউন্সিলরের জন্য বিধানসভায় দল বেশ কয়েকটি আসন হারিয়েছে। বেশ কিছু আসনে জয়ের ব্যবধানও গত বারের চেয়ে কমেছে।

মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, গত এক মাস জেলা সফরে গিয়ে নেত্রী বার বার করে দলকে এ সব ব্যাপারে সতর্ক করছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, কাউন্সিলরেরা জমি-বা়ড়ির নকশা অনুমোদনের কাজ ছে়ড়ে মানুষের পরিষেবায় মন দিন। কিন্তু তার পরেও বিভিন্ন পুরসভার কাউন্সিলর ও নিচু তলার কিছু নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের খামতি নেই! তাই প্রশ্ন উঠছিল যে, মুখ্যমন্ত্রী সতর্ক করার পরেও কাজটা হচ্ছে কোথায়? অনিন্দ্যকে গ্রেফতারির মধ্যে দিয়ে সেই কাজটাই করে দেখিয়ে গোটা দলকে বার্তা দিলেন মমতা— মনে করছেন অনেকে।

‘আমি এ সব টলারেট করব না’— মমতার এই মন্তব্যের একটি অন্য ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন দলের কিছু নেতা। তাঁদের মতে, তোলাবাজি-জুলুমবাজিতে শুধু স্থানীয় নেতা বা কাউন্সিলর নন, দলের কিছু তাবড় নেতা-নেত্রীর নামও জড়িয়ে গিয়েছে। গত কয়েক বছরে নিজের চেষ্টায় দলের যে ভাবমূর্তি মমতা তৈরি করেছেন, কিছু নেতা-নেত্রীর জন্য তাতে যথেষ্ট কালি লেগেছে। এটা যে তিনি আর মেনে নেবেন না, এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেটাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, দলে অনিন্দ্যর ভবিষ্যৎ কী? তৃণমূলের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এমনকী তাঁর স্থানে মেয়রের মাধ্যমে একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করে পুর পরিষেবার কাজ চালানোর মতো কড়া সিদ্ধান্তও নিয়েছে দল।

তৃণমূল সূত্রের খবর, বেশ কিছু কাউন্সিলর ও দলের নিচু স্তরের কিছু নেতা-নেত্রীর জীবনযাত্রা, আচার-আচরণের কথাও মুখ্যমন্ত্রীর কানে এসেছে। রাতারাতি তাঁদের বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে ওঠার কথাও জানতে পেরেছেন তিনি। দলের এক নেতা জানান, কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি। কারণ, বাড়ির নকশা অনুমোদন ও মিউটেশন, জলের লাইন-সহ বিভিন্ন কাজে তাঁদের অনুমতি না লাগলেও কাউন্সিলরদের নাক গলানোর সুযোগ রয়েছে। কী ভাবে? কলকাতা পুরসভার এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘পরিষেবার কাজে কাউন্সিলরের অনুমতি না লাগলেও তাঁদের ক্ষমতা কম, এটা ভাবার কারণ নেই। কারণ, অধিকাংশ ওয়ার্ডেই পুর অফিসারেরা কাউন্সিলরের কথায় চলতে বাধ্য হন। আর জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে ভয় পান স্থানীয় মানুষ। এই ছিদ্রপথেই তোলা আদায় চলতে থাকে।’’

Extortion CM Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy