Advertisement
E-Paper

স্বরূপেই বিশ্বাস দলের, মুখ খুলে কোণঠাসা শোভনদেব

এলাকায় প্রভাব ধরে রাখতে, দলের আয় বাড়াতে এবং সর্বোপরি ভোটে জিততে তাঁদের অবদান কাজে লাগে। তাই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও তাঁর ভাই স্বরূপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ই! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার শোভনদেবকে ফোনে ‘ভর্ৎসনা’ করেছেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। পরিষদীয় সচিবদের পদ খারিজের মামলায় উচ্চতর আদালতে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দায়ের করা নিয়ে আলোচনা চলছে শাসক দলের অন্দরে

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:৫০
স্বরূপ বিশ্বাস, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও অরূপ বিশ্বাস

স্বরূপ বিশ্বাস, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও অরূপ বিশ্বাস

এলাকায় প্রভাব ধরে রাখতে, দলের আয় বাড়াতে এবং সর্বোপরি ভোটে জিততে তাঁদের অবদান কাজে লাগে। তাই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও তাঁর ভাই স্বরূপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ই!

স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার শোভনদেবকে ফোনে ‘ভর্ৎসনা’ করেছেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। পরিষদীয় সচিবদের পদ খারিজের মামলায় উচ্চতর আদালতে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দায়ের করা নিয়ে আলোচনা চলছে শাসক দলের অন্দরে। সেই ব্যাপারে সরকার তাদের অবস্থান চূড়ান্ত করার আগেই সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব কেন পরিষদীয় সচিবদের খাতায় সই করতে বারণ করার কথা প্রকাশ্যে বলতে গেলেন, তা নিয়ে জবাবদিহি চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, পরিষদীয় সচিবের প্রসঙ্গ ছিল নেহাতই উপলক্ষ। আসলে মন্ত্রী অরূপের বিরুদ্ধে বিধানসভার লবিতে প্রকাশ্যে মুখ খোলার জন্যই বর্ষীয়ান বিধায়কের উপরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মমতা। দলনেত্রীর মনোভাব বুঝে নিয়ে শোভনদেব এ দিন আর কোনও বিষয়েই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে মুখ্যমন্ত্রীর তিরস্কারের খবরও অস্বীকার করা হয়েছে।

নিউ আলিপুরের সাহাপুর কলোনি এলাকায় রবিবার রাতে শোভনদেবের অনুগামী বলে পরিচিত আইএনটিটিইউসি-র এক স্থানীয় নেতা সৌমেন মালাকারের উপরে হামলা হয়েছিল। অভিযোগের তির অরূপের ভাই স্বরূপের লোকজনের দিকে। স্বরূপের স্ত্রী ওই এলাকার কাউন্সিলর। স্বরূপের অবশ্য পাল্টা দাবি, সৌমেনের সঙ্গে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু রবিবারের ঘটনার পরেই সোমবার বিধানসভার লবিতে অরূপকে পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন শোভনদেব। রাগত স্বরে প্রশ্ন তুলেছিলেন, অরূপ ও তাঁর ভাই কি ‘গুন্ডারাজ’ চালাবেন? কলকাতা শহরের দুই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত তৃণমূলের দুই প্রথম সারির নেতার মধ্যে এমন বিরোধের ঘটনায় আলোড়ন পড়ে যায় দলের অন্দরে। শোভনদেব ও অরূপ, দু’জনেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হন। এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন শোভনদেবকে তিরস্কার করেছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। দলের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও শোভনদেব শীর্ষ নেতৃত্বকে জানানোর আগে প্রকাশ্যে মুখ খুলে কেন দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি করলেন, সেই প্রশ্নই তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী।

শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা এ দিন বলেছেন, ‘‘নিউ আলিপুরে ঘটনা যা-ই ঘটে থাক, এ বার বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেবই দলে সমস্যায় পড়েছেন। ও ভাবে সকলের সামনে মুখ খুলে তিনি দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেননি বলেই দল মনে করছে।’’ তবে এ ব্যাপারে দলীয় স্তরে কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলের কোনও নেতা মুখ খুলতে চাননি। অরূপও এ দিন বলেছেন, ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’

তৃণমূলের অন্দরের খবর, নিউ আলিপুর, তারাতলা, টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিশ্বাস ভাইয়েরাই সর্বেসর্বা। টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় শাসক দলের হয়ে কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন তাঁরাই। তাঁদের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে কলাকুশলী পর্যন্ত কারও কাজ পাওয়ার উপায় নেই, এমন অভিযোগ টলিউ়ড থেকে উঠছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। টলিউডে তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে যে কয়েক জন প্রকাশ্যেই অন্য রাজনৈতিক দলের ছাতায় গিয়েছেন, তাঁরা স্বরূপদের নামেই অভিযোগ করেছেন। যদিও অরূপ-স্বরূপেরা পাল্টা বলে এসেছেন, টালিগঞ্জে কলাকুশলীদের যে ইউনিয়ন আছে, তা অরাজনৈতিক এবং নির্বাচিত। নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে তো তাঁরা তৃণমূলের নামে সংগঠন খুলতেন!

তবে তাঁরা এমন দাবি করলেও এলাকার বক্তব্য, বারো মাস স্টুডিও পাড়া নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ভোটের সময় দলের বৈতরণী উতরে দেওয়ার ভার থাকে স্বরূপদের কাঁধেই। তাই শোভনদেবের মতো প্রবীণ নেতাদের চেয়ে অরূপ-স্বরূপদের উপরেই দলীয় নেতৃত্বের অগাধ বিশ্বাস, এমনই ব্যাখ্যা মিলছে শাসক দলের অন্দরে। নিউ আলিপুরে যেমন অরূপ-স্বরূপ, তেমনই অন্য নানা এলাকায় এমন নানা চরিত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের ভিতরে-বাইরে বহু অভিযোগ পেয়েও সচরাচর দলীয় নেতৃত্ব তা-ই নিয়ে রা কাড়ছেন না!

বস্তুত, তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, আগামী বিধানসভা ভোটে রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে শোভনদেব ফের লড়ুন, তা চায় না দলেরই একাংশ। তাই পরিকল্পনামাফিক শোভনদেবের অনুগামীদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে ওই অংশের অভিমত। দলের এক যুব নেতার কথায়, ‘‘কেউ কেউ চাইছেন, বারবার নানা ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পঙ্কজদা’র (প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়) মতো শোভনদা নিজেই সরে যান। তা হলে কারও কারও রাস্তা সাফ হয়ে যায়!’’ স্বয়ং শোভনদেব ও অরূপ এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি। আর স্বরূপ পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছেন, ‘‘যাঁরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তাঁরা একটা অভিযোগও প্রমাণ করতে পারলে আমি সব দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করব!’’ প্রসঙ্গত, স্বরূপ দক্ষিণ কলকাতা জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি।

স্বরূপ অস্বীকার করলেও অরূপের ভাই ও তাঁর দলবলের কাজকর্ম নিয়ে অভিযোগ অবশ্য শুধু রাসবিহারীর বিধায়কেরই নয়। স্থানীয় বহু মানুষই সে সবের ভুক্তভোগী। অধুনা তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছেন সেই তালিকায়। নিউ আলিপুরে তাঁর একটি জমিতে পাঁচ তলা বাড়ি তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। জমিটি তিনি দিয়েছেন এক প্রোমোটারকে। চুক্তি অনুযায়ী, ওই বাড়ির অর্ধেক মালিকানা পাবেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওই বাড়ি তৈরি শুরুর মুখে তাঁকেও শাসক দলের ওই স্থানীয় নেতাকে পাঁচ লক্ষ টাকা তোলা দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রশ্ন করা হলে এ দিন দেবব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে ওঁদের কোনও কথা হয়নি। টাকাটা চেয়েছিল ওই বাড়ির স্থপতির কাছে। পরে উনি আমাকে জানান, একটু কমে ‘রফা’ হয়ে গিয়েছে।’’ কিন্তু টাকা চাওয়ার কথাটা তো তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন?

সরাসরি জবাব এড়িয়ে সাংসদের উত্তর, ‘‘আমি কয়েক জনকে বলেছিলাম। এখন আর নাম মনে নেই।’’ প্রশ্ন ছিল, বাড়ির মালিক হিসাবে তোলার টাকাটা তো তাঁকেই দিতে হবে। স্থপতি সেই টাকা তাঁর কাছে চাননি? দেবব্রতবাবু বলেন, ‘‘তা চাইবেন কেন! নিশ্চয়ই ইট-বালির বিলের মধ্যে ওই অঙ্কটা ঢুকে গিয়েছে!’’ দেবব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমি কোনও নাম বলছি না। তবে কিছু লোক আছেন, যাঁদের রোজগারটাই হল প্রতিদিন তোলা আদায় করা!’’

অভিযোগ উড়িয়ে স্বরূপের বক্তব্য, ‘‘এলাকায় আমাদের বিশ্বাস পরিবারের যথেষ্ট মান-সম্মান আছে। আমার এমন কোনও পারিবারিক দুরবস্থা হয়নি যে, বেআইনি কাজকর্ম করে উপার্জন করতে হবে! তা ছাড়া, আমি ব্যবসা করি।’’ যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা স্বরূপকে কোথাও চাকরি বা ব্যবসা করতে দেখেননি। দুর্গাপুর ক্যাম্পের অ্যাসবেস্টস দেওয়া বাড়ি ছেড়ে বছরখানেক হল অরূপ, স্বরূপ এবং তাঁর স্ত্রী জুঁই বিশ্বাস থাকেন সাহাপুর কলোনির মুক্তি সঙ্ঘের মাঠের পাশে দু’টি বিশাল ফ্ল্যাটে। যার বাজারমূল্য নিয়ে নানা জল্পনা!

শোভনদেব বা দেবুবাবুর মতো শাসক দলেরই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেখানে জুলুমবাজির শিকার, সেখানে ভুক্তভোগী বহু সাধারণ মানুষের সন্ধান স্বরূপদের এলাকায় মিলবে, সেটাই স্বাভাবিক! স্থানীয় মানুষেরই অভিযোগ, টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে কে কোথায় হকারি করবেন, তা-ও ঠিক করেন স্বরূপ। অভিযোগ, তারাতলার মোড়ে মিত্র বাড়ির দরজার সামনে ফুটপাথ জুড়ে হঠাৎই একটি হোটেল বসিয়ে দিয়েছিলেন স্বরূপ। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে তারস্বরে গান বাজত। নিউ আলিপুর থানায় বার বার অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ৬৭ বছরের মধুগীতি মিত্রের অভিযোগ, ‘‘আমার স্বামী পেশায় আইনজীবী। তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে, স্বরূপদা বসিয়েছে। তাঁকে এবং তাঁর ক্লাবকে টাকা দিয়েছি। আমায় কেউ কিছু করতে পারবে না!’’ নিরুপায় হয়ে তৃণমূলের তৎকালীন রাজ্য সভাপতি এবং এলাকার সাংসদ সুব্রত বক্সীকে ফোন করে অভিযোগ জানান তিনি। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘দেখছি।’’ কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরাসরি অরূপেরই দ্বারস্থ হন ওই আইনজীবী। তখন আর হস্তক্ষেপ না করে উপায় ছিল না অরূপের। মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ওই দোকানের জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। যদিও এই অভিযোগ নিয়ে স্বরূপের জবাব, ‘‘টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আমাদের জন্মের আগে থেকে হকার রয়েছে! যারা ওখানে বসে আছে, তারা অধিকাংশই মাঝেরহাট কলোনির বাসিন্দা। যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, এ রকম ঘটনা জানা নেই।’’

আরও অভিযোগ, এলাকায় কোনও বা়ড়ি উঠলেই টাকা দিতে হয় স্বরূপ বাহিনীকে! না হলেই কাজ বন্ধ! বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হলেই সঙ্গে দু’-এক জন পুলিশ নিয়ে হাজির হন স্বরূপ। বাড়ির নকশা দেখতে চাওয়া হয়। তার পরে নানা ভাবে চাপ দিয়ে টাকা তোলা হয়। সঙ্গে ইট, বালি, সিমেন্টের অর্ডার। না দিলেই কাজ বন্ধ। অসংখ্য অভিযোগ গিয়েছে সাংসদ এবং খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও। কোনও হেলদোল হয়নি। যদিও স্বরূপের বক্তব্য, ‘‘এ রকম কোনও অভিযোগ আমি জানি না!’’ নিউ আলিপুর ত্রিকোণ পার্কের কাছে একটি অবাঙালি ব্যবসায়ীর নামী মিষ্টির দোকানকে সাহায্য করার জন্য বেআইনি ভাবে গভীর নলকূপ বসানো নিয়েও এক বার স্বরূপের সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল শোভনদেবের। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে ওই উদ্যোগ আটকে দেন শোভনদেব। এই বিষয়েও স্বরূপের বক্তব্য, ‘‘আমাদের ওয়ার্ডে এ রকম গভীর নলকূপ বসেইনি!’’

ঘটনাপ্রবাহই বলছে, স্বরূপদের দাপটই অব্যাহত থেকেছে বারবার। কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন শোভনদেবেরা!

mamata bandopadhyay Sobhandeb Chattopadhyay arup biswas swarup biswas trinamool TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy