ইঙ্গিত ছিলই। সোমবার তা আরও স্পষ্ট। দায়িত্ব ছেড়ে আগামী ৪ জুলাই চেন্নাই ফিরে যাচ্ছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্যপাল এ দিনই তাঁর ইস্তফার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। সেইমতোই আজ, মঙ্গলবার থেকে যাবতীয় সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে আর যোগ দিতে যাবেন না তিনি। সরকারি ভাবে নারায়ণন তাঁর ইস্তফা নিয়ে মুখ না খুললেও ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদ থেকে সরেই দাঁড়াচ্ছেন প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
মেয়াদ ফুরনোর আগেই রাজ্যপালের এই বিদায়-পর্বকেই কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে কৌশলে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্যকালে যাঁর সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক সর্বদা মধুর ছিল না মোটেও, বিদায়ের প্রহরে তিনিই এখন হয়ে উঠেছেন সেই সরকারের আপন জন! মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন সরাসরি রাজ্যপালের সরে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ঠিকই। কিন্তু নারায়ণন কলকাতা ছাড়ার আগেই কাল, বুধবার রাজ্য মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিদায়ী রাজ্যপালের প্রতিই তাঁর আস্থা আছে। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার নারায়ণন সম্পর্কে আবেগঘন মন্তব্য করে আঙুল তুলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই। তৃণমূল সরকার এখন প্রতীক্ষা করছে, নারায়ণনের জায়গায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার রাজ্যপাল হিসাবে কাকে পাঠায়, তা দেখার জন্য।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তিনি ধরেই রেখেছেন সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ এ বার রাজভবনের বাসিন্দা হবেন। এবং তিনি এসে নিজের তাগিদেই এমন কিছু পদক্ষেপ করতে পারেন, যাতে কেন্দ্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ছাপ থাকবে। বাস্তবে তেমন ঘটলে তখন ওই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে বিজেপি-র বিরুদ্ধে নিজের মতো করে রাজনৈতিক জমি গোছানোর চেষ্টা করতে পারবেন তৃণমূল নেত্রী। তবে তৃণমূলেরই একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, তাঁর আস্তিনের রাজনৈতিক তাস এখনই দেখাতে চান না বলে মানসিক ভাবে নারায়ণনের পাশে দাঁড়িয়েও তাঁর জন্য কোনও বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করছেন না মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু গোটা মন্ত্রিসভাকে রাজ্যপালের কাছে হাজির করিয়ে মন্ত্রিসভার রদবদলের কাজ এর মধ্যেই সেরে ফেলে সুকৌশলে সেই বিদায় সম্ভাষণই তিনি জানাতে চাইছেন! মেয়াদ শেষের প্রায় সাত মাস আগেই যে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে চান, তা গত ১৭ জুনই রাজভবনের অফিসার-কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণন। সে দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীও রাজভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসেন। তখন থেকেই রাজ্যপাল নিষেধ করে দিয়েছিলেন ১ জুলাই থেকে আর কোনও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ নেওয়ার ব্যাপারে। ইতিমধ্যে তাঁর জিনিসপত্র গোছানোর কাজও সারা! গত শুক্রবার রাজভবনে এসে সিবিআইয়ের চার অফিসার অগাস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড কপ্টার কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যপালের বয়ান নেওয়ার পরে এই বিদায় প্রক্রিয়াই আরও গতি পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত নারায়ণন পদত্যাগ করেছেন শুনে এ দিন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ, প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেন, পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু-সহ শহরের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। রাজভবন সূত্রের খবর, আগামী তিন দিনও নিয়মমাফিক নিজের দফতরে কাজকর্ম করবেন নারায়ণন।
রাজ্যপালের ইস্তফার খবর নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন বলেন, “সাংবিধানিক পদ। আমি এই নিয়ে কিছু বলব না।” রাজ্যপালকে বিদায় সংবর্ধনা দেবেন? মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “উনি ৪ তারিখ চলে যাবেন। আমরা সংবর্ধনা করছি না। তবে ২ তারিখ একটা ছোট্ট রদবদল করব।” শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু অবশ্য কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। বিরোধী দলনেতা হিসাবে এবং পরে মন্ত্রী হিসাবে নারায়ণনের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে পার্থবাবু বলেছেন, “এক জন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিভাবককে হারালাম!” সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এ ভাবে অকস্মাৎ তাঁর চলে যাওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল না। যাঁরা এ কাজ করছেন, তাঁরাই জানেন এতে কতটা মঙ্গল হবে!”
পার্থবাবুরা এখন এ কথা বললেও শিক্ষাঙ্গনে ‘গুন্ডামি’ চলছে বলে রাজ্যপাল নারায়ণনের মন্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে টানাপড়েনে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের পাশে তাঁর দাঁড়ানো বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে রাজ্যপালের আপত্তি নানা সময়েই নারায়ণনের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে মমতার সরকারের। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে সব তিক্ততাই এখন রাজ্য সরকার বদলে নিতে চাইছে মাধুর্য-অস্ত্রে!
ঠিক এই রাজনীতির কথাই এ দিন বলতে চেয়েছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। নারায়ণনকে ফোন করে বিদায়-সাক্ষাতের আর্জি জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেছেন, “সঙ্ঘের কট্টরপন্থী কেউ যদি রাজ্যপাল হয়ে আসেন, আমরা অবাক হব না! তখন দেখতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা কী হয়!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy