ছুটি নিয়ে ফের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সংঘাতে নামল কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন।
কোনও আইনজীবীর মৃত্যুতে হঠাৎ করে কর্মবিরতির বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সংঘাত বাধছিল আইজীবীদের। এ বার তার সঙ্গে যোগ হল গরমের ছুটি বাড়ানোর বিষয়টি। ১৫ দিনের গরমের ছুটির পরে গত ১ জুন হাইকোর্ট খুলেছিল। ন’দিন কাজ চলার পরে মঙ্গলবার হঠাৎ করে বার অ্যাসোসিয়েশন বুধবার থেকে তিন দিনের কর্মবিরতির ডাক দেয়। কারণ? অত্যধিক গরম।
আইনজীবীদের এ হেন দাবি শুনে আদালত যে ক্ষুব্ধ, তা স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতির মন্তব্যেই। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী আইনজীবীদের কাছে জানতে চান, ‘‘ট্রাফিক পুলিশ, ট্রাফিক সার্জেন্টরা রাস্তায় নেমে কাজ করছেন না?’’ বিচারপতি বাগচীর কথার রেশ ধরেই প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর প্রশ্ন করেন, ‘‘গরমে চিকিৎসক, নার্সরা কাজ করছেন না? তাঁদের কাজের জায়গা কি পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত? স্কুলের বাচ্চাদের মতো আপনারা কেবল ছুটি চান কেন?’’
গত বছর অগস্টে কলকাতা হাইকোর্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিচারপতি চেল্লুর কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর চেষ্টা করেছেন বারবার। কর্মবিরতির আন্দোলন নিয়ে একাধিক ক্ষেত্রে সরব হয়েছেন তিনি। আইনজীবীদের একাংশকে ভর্ৎসনাও করেছেন। কিন্তু এ দিন যে ভাবে গরমের জন্য বার অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে, তাতে তিনি যে পুরোপুরি হতাশ, তা প্রধান বিচারপতির মন্তব্যেই পরিষ্কার। প্রধান বিচারপতি চেল্লুর আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি সত্যিই হতোদ্যম হয়ে পড়ছি। তবে, হাল ছাড়ছি না।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে সব রাজ্যে এখানকার থেকেও বেশি গরম, সেখানকার আইনজীবীরাও গরমের অজুহাতে এ ভাবে ছুটি চান না!’’
শুধু বিচারপতিরা নন, কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবীদের অনেকেই এই কর্মবিরতির আন্দোলনের সিদ্ধান্তে বিরক্ত। একটি মামলার শুনানির জন্য এ দিন প্রধান বিচারপতির এজলাসে উপস্থিত আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, ‘‘স্কুলের বাচ্চারাও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় নিয়মিত স্কুলে যায়।’’ পাশে ছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমার নাতনি এ বার না আমায় বলে বসে, তোমরা খালি বাচ্চাদের মতো ছুটি নাও!’’ পরে জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘তীব্র গরমে বিচারপ্রার্থীরা দূরদূরান্ত থেকে নৌকো, ট্রেন, বাসে ঘামতে ঘামতে হাইকোর্টে এসে দেখবেন, তাঁদের আইনজীবীরা গরমের দোহাই দিয়ে কাজে আসেননি! কী লজ্জার কথা!’’ এ সব মন্তব্য শোনার পরেও কিন্তু বার অ্যাসেসিয়েশন তাদের কর্মবিরতির আন্দোলনের সিদ্ধান্ত থেকে সরেনি।
এর আগে কোনও আইনজীবীর মৃত্যুতে হুটহাট করে কখনও বেলা সাড়ে ১০টায়, কখনও বেলা দু’টোয় আবার কখনও বেলা সাড়ে তিনটেয় কর্মবিরতি পালন করেছেন হাইকোর্টের আইনজীবীদের বড় অংশ। আইনজীবীদের কাজ না করারমানসিকতার বারবার সমালোচনা করে বার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি চান সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে বছরে কমপক্ষে ২১০ দিন খোলা থাকুক হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি এ-ও চেয়েছেন যে, একান্তই বিশেষ কোনও কারণে কর্মবিরতি পালন করতে হলে আইনজীবীরা শনিবারে কাজ করে তা পুষিয়ে দিন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। আইনজীবীরা ছুটির দিন এবং শনিবারে কাজ করতে অস্বীকার করেই কর্মবিরতির আন্দোলনে সামিল হয়েছেন।
অত্যধিক গরমের জন্য বিভিন্ন জেলা আদালতের আইনজীবীরা গত ১০-১৫ দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া মাথায় উঠেছে। এ বার তার ঢেউ এসে পড়ল হাইকোর্টেও। এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা শুরু হয়। সভা শেষ হয় পৌনে দু’টোয়। বেলা দু’টোয় আদালতের কাজ ফের শুরু হয়। প্রধান বিচারপতি ও ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এজলাসে বসেন। অন্য একটি মামলার শুনানিতে আদালতে হাজির ছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র, আইনজীবী এক্রামুল বারি, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরা। কথায় কথায় প্রধান বিচারপতিই কর্মবিরতির প্রসঙ্গ তোলেন।
তবে বার অ্যাসোসিয়েশনের এ বারের কর্মবিরতির আন্দোলনে কিন্তু হাইকোর্টের আইনীবীদের বড় একটি অংশের সমর্থন ছিল না। কর্মবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগেই বেশ কয়েক জন আইনজীবী তথা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ওই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। রাজ্য তৃণমূল আইনজীবী সেলের সাধারণ সম্পাদক তথা রাজ্য বার কাউন্সিলের সদস্য প্রসূন দত্ত সাধারণ সভায় বলেন, ‘‘সংগঠনের এক জন সদস্য গরমের কারণে কর্মবিরতি চাইছেন। তিনি গরমের ছুটিতে যে চার দিন হাইকোর্ট খোলা ছিল, সেই চার দিন মামলা লড়েছেন। তখন গরম তাঁকে কাহিল করেনি!’’
রাজ্য তৃণমূল আইনজীবী সেলের সহ-সভাপতি অসীম গঙ্গোপাধ্যায় সভায় বলেন, ‘‘গরমের ছুটি শেষে ১ জুন হাইকোর্ট খুলল। তার পরে আদালতে স্বাভাবিক কাজ হল। ন’দিন পরে ফের গরমের কারণে কর্মবিরতি কেন?’’ কর্মবিরতির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে একাধিক প্রবীণ আইনজীবী সভায় জানান, এই ভাবে কর্মবিরতি হলে রাস্তাঘাটে আইনজীবীদের সমালোচনা শুনতে হবে। মানুষ বলবে, আইনজীবীরা ‘অ-সামাজিক’!
হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সংগঠনের ১৬৭ জন সদস্য গরমের কারণে কয়েক দিন কাজ বন্ধ রাখতে চেয়ে আমাকে সোমবার একটি চিঠি দেন। তার ভিত্তিতেই এ দিন সাধারণ সভা ডাকা হয়। সভায় হাত তুলে ভোটাভুটিতে তিন দিনের কর্মবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত আমার একার নয়।’’ একই সঙ্গে তিনি জানান, সভায় এ-ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী সোমবার বেলা সাড়ে ১০টায় ফের সাধারণ সভা হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কর্মবিরতি চলবে না আদালতের স্বাভাবিক কাজে আইনজীবীরা অংশ নেবেন। রানাবাবুর দাবি, ‘‘আশা করছি, সোমবার থেকেই আইনজীবীরা কাজে যোগ দেবেন।’’
আইনজীবীদের একাংশ আবার এ সবের জন্য পরোক্ষে প্রধান বিচারপতিকেই দুষছেন। তাঁরা বলছেন, হাইকোর্টের কর্মবিরতি আন্দোলন বন্ধে প্রধান বিচারপতি যতটা সক্রিয়, নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে তিনি ততটাই নিষ্ক্রিয়। গরমের শুরু থেকেই এ বার বিভিন্ন নিম্ন আদালতে কর্মবিরতির আন্দোলনে সামিল হয়েছেন আইনজীবীরা। বিচারপ্রার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে এসেও ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু তখন হাইকোর্ট কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। এক প্রবীণ আইনজীবীর মন্তব্য, ‘‘গরমের কারণ দেখিয়ে গত মাসে যখন নিম্ন আদালতগুলিতে কর্মবিরতির আন্দোলন চলছিল, তখনই যদি প্রধান বিচারপতি সক্রিয় হতেন, তা হলে হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন এ দিন কর্মবিরতির আন্দোলনে সামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই সাহস পেত না। প্রথমে কড়া হতে না পারার মাসুল দিচ্ছে কলকাতা হাইকোর্ট।’’