Advertisement
০৭ মে ২০২৪

হাসপাতালে কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধ নষ্ট, আঙুল দুষ্টচক্রের দিকেই

সরকারের তরফে হাসপাতালে বিনামূল্যে নানান ওষুধ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু ওষুধ না-পেয়ে দোকানে দৌড়তে হচ্ছে রোগী বা তাঁর সঙ্গীদের। অথচ লক্ষ লক্ষ টাকার ওষুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের ভাঁড়ারেই!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

সরকারের তরফে হাসপাতালে বিনামূল্যে নানান ওষুধ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু ওষুধ না-পেয়ে দোকানে দৌড়তে হচ্ছে রোগী বা তাঁর সঙ্গীদের। অথচ লক্ষ লক্ষ টাকার ওষুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের ভাঁড়ারেই!

খাস কলকাতারই এমন একটি সরকারি হাসপাতালে মজুত ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর তালিকা দেখে স্বাস্থ্য ভবন হতবাক! ওই তালিকা বলছে, গত এক বছরে কেনা অন্তত ৪০ ধরনের প্রাণদায়ী ওষুধ, ইঞ্জেকশন, স্যালাইন এবং শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার কিট পড়ে রয়েছে ওই হাসপাতালের ফার্মাসিতে। এবং তাদের ব্যবহারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, এই ধরনের মজুত ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর মূল্য এক কোটি টাকার কাছাকাছি। সেই সব নষ্ট ওষুধ আর কোনও কাজেই লাগবে না। ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

ফুলবাগানের বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালের পাঠানো মজুত ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর তালিকা দেখে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের সন্দেহ, এক শ্রেণির ওষুধের দোকানের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মীদের একাংশের যোগসাজশ থাকতে পারে। তাই হাসপাতালের ফার্মাসিতে ওষুধ থাকলেও তা রোগীদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ওই হাসপাতালের খবর, এই মুহূর্তে তাদের ফার্মাসিতে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার (সংখ্যায় প্রায় আট লক্ষ) অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট পড়ে রয়েছে, যার মেয়াদ চলতি মাসেই শেষ হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ এর পিছনে একটি সংগঠিত চক্রের হাত দেখছেন। তাদের কারসাজিতেই সরকারি হাসপাতালের ফার্মাসিতে গিয়ে ওষুধ না-পেয়ে রোগী বা তাঁদের রোগীর আত্মীয়দের প্রায়ই ফিরে আসতে হয়। অনেক সময় ফার্মাসি থেকেই সাদা কাগজে নির্দিষ্ট ওষুধ এবং ওষুধের দোকানের নাম লিখে নিতে বলা হয় রোগীর আত্মীয়দের। পাছে হাতের লেখা ধরা পড়ে যায়, তাই ফার্মাসির লোকজন বা কিছু ডাক্তার নিজেরা সেটা লেখেন না। রোগীর সঙ্গীদের দিয়ে তা লিখিয়ে নিয়ে তাঁদেরই পাঠিয়ে দেওয়া হয় দুষ্টচক্রের অন্তর্ভুক্ত দোকানে। কিছু চিকিৎসক এমন ওষুধের কথা বলেন, যা হাসপাতালের ভাঁড়ারে মেলে না। রোগী বা তাঁর সঙ্গীদের বাধ্য হয়েই ছুটতে হয় নির্দিষ্ট দোকানে। হাসপাতালের ওষুধ থেকে যায় ভাঁড়ারেই। রোগী বাইরে থেকে ওষুধ কেনায় স্বার্থসিদ্ধি হয় ওই চক্রেরই।

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশু হাসপাতালের ভাঁড়ারে যে-সব ওষুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে, তার মধ্যে আছে ‘জননী ও শিশু সুরক্ষা যোজনা’য় দেওয়ার সাত ধরনের ওষুধও। ‘ক্যাটলগ আইটেম’ বা স্বাস্থ্য দফতরের তালিকাভুক্ত ওষুধ রয়েছে প্রায় ৩০ ধরনের। আছে ‘নন-ক্যাট’ বা সরকারি তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রায় সাত ধরনের ওষুধ-ইঞ্জেকশন। ওষুধ সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘কয়েক মাস ধরে আমাদের কাছে বিভিন্ন ভাবে খবর আসছিল, বি সি রায়ে ভর্তি রোগীর আত্মীয়দের অনেককেই বাইরে থেকে ওষুধ, পরীক্ষার কিট কিনে আনতে বলা হচ্ছে। বাধ্য হয়েই তাঁরা তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই হাসপাতালের ফার্মাসিতে মজুত ওষুধের তালিকা পেয়ে এখন বুঝতে পারছি, আসল ব্যাপারটা কী।’’

কী বলছেন বি সি রায় হাসপাতালের ওষুধের দায়িত্বে থাকা ফার্মাসিস্ট সোমনাথ রায়?

এক শ্রেণির ডাক্তারের উপরে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন সোমনাথবাবু। বলছেন, ‘‘অনেকেই হাসপাতালে মজুত ওষুধের নাম না-লিখে অন্য ওষুধ দিচ্ছেন। দু’তিন মাস অন্তর ওষুধ বদল করে দিচ্ছেন। ফলে ফার্মাসির ওষুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।’’

চিকিৎসকেরা এই অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁদের এক জন বলেছেন, ‘‘রোগীদের আত্মীয়স্বজন হাসপাতালের ফার্মাসিতে ওষুধ না-পেয়ে আমাদের কাছেই ফিরে আসেন। তখন আমাদের বাধ্য হয়েই অনেক ক্ষেত্রে তালিকার বাইরে থাকা ওষুধের নাম লিখে দিতে হয়।’’

চিকিৎসকদের এই অভিযোগ শুনে সোমনাথবাবু জানাচ্ছেন, অনলাইনে পাঠানো তালিকায় যে-সব ওষুধ-ইঞ্জেকশন-কিট নষ্ট হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে বা দেখানো হচ্ছে, সেগুলো ভুলবশত লেখা হয়েছে। আসলে তা খরচ হয়ে গিয়েছে। ‘‘আমাদের লোকবল কম। তাই কম্পিউটারে তুলতে গিয়ে একটু-আধটু ভুলভাল হচ্ছে,’’ বলছেন সোমনাথবাবু।

কিন্তু এই কম্পিউটারের হিসেবই তো ‘চূড়ান্ত’ বলে হাসপাতালের তরফে স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো হয়েছে। এবং অনলাইনে পাঠানো সেই হিসেব ধরেই তো অডিটের কাজ হবে। ওই চূড়ান্ত হিসেবে যে ভুল রয়েছে, সেটা তো স্বাস্থ্য ভবনকে বলা হয়নি। এ ব্যাপারে ফার্মাসিস্টের বক্তব্য কী?

এর জবাবে আর ডাক্তার নয়, খাস স্বাস্থ্য ভবনের দিকেই আঙুল তুলছেন সোমনাথবাবু। তাঁর অভিযোগ, এর আগে হাসপাতালের তরফে বেশ কয়েক বার স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল যে, বেশ কিছু ওষুধ-ইঞ্জেকশন-কিট পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। সেগুলো যেন অন্য হাসপাতালে বণ্টন করে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবন কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। বরং তাঁরা (সোমনাথবাবুরা) নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিছু ওষুধ অন্য হাসপাতালে দিয়েছিলেন।

যদিও স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, বি সি রায় থেকে এমন কোনও চিঠি সেখানে পৌঁছয়নি। যেটা পৌঁছেছে, তা হল ফার্মাসিতে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ওষুধের তালিকা। আর তাতেই ধরা পড়েছে বিরাট গরমিল।

এর পরে স্বাস্থ্য ভবন কী করবে?

‘‘ওষুধ ফেলে রেখে নষ্ট করা হচ্ছে। আর রোগীর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যাঁদের পকেট থেকে টাকা খরচ করে দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে, তাঁরা ভাবছেন, সরকার ফ্রি-তে ওষুধ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রাখছে না। আমরা এর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবো,’’ দৃঢ় সঙ্কল্পের কথা বলেছেন স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medicine waste
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE