Advertisement
০২ মে ২০২৪
তিন মহিলা খুনে দোষী ১৪ জন

‘ডাইনি-গ্রামে’ ফেসবুকে মেতে ছেলেরা

সাড়ে তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আজও বুকের ভিতরে আঁকড়ে রেখেছে দুবরাজপুর গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ও ডেবরা থানা সীমান্ত এই দুবরাজপুর গ্রামেই সাড়ে তিন বছর আগে ডাইনি অপবাদে তিন মহিলাকে বাঁশ পেটা করে খুন করেছিলেন প্রতিবেশীরা। নদীর চরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল তিনটি দেহ।

এই চরেই পোঁতা ছিল তিনটি দেহ। (ডান দিকে) এজলাসের পথে জানগুরু সমাই মাণ্ডি। — নিজস্ব চিত্র।

এই চরেই পোঁতা ছিল তিনটি দেহ। (ডান দিকে) এজলাসের পথে জানগুরু সমাই মাণ্ডি। — নিজস্ব চিত্র।

অভিজিৎ চক্রবর্তী
দুবরাজপুর (দাসপুর) শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০১:৩২
Share: Save:

সাড়ে তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আজও বুকের ভিতরে আঁকড়ে রেখেছে দুবরাজপুর গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ও ডেবরা থানা সীমান্ত এই দুবরাজপুর গ্রামেই সাড়ে তিন বছর আগে ডাইনি অপবাদে তিন মহিলাকে বাঁশ পেটা করে খুন করেছিলেন প্রতিবেশীরা। নদীর চরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল তিনটি দেহ।

এখন সেখানেই মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসে রয়েছেন গ্রামের যুবকেরা। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।

তিন মহিলাকে খুনের ঘটনায় দুবরাজপুর ও পড়শি গ্রাম হরিরাজপুরের মোট ২২জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। শুক্রবার ঘাটালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দেবপ্রসাদ নাথ আট জন মহিলা-সহ মোট ১৪ জনকে দোষী সব্যস্ত করেন। সকলেই খুন ও তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত। তথ্য প্রমাণের অভাবে বাকিরা বেকসুর খলাস পেয়েছেন। আগামী সোমবার ঘাটাল আদালতে দোষীদের সাজা ঘোষণা করবেন বিচারক।

তার আগে, দুবরাজপুরে ধরা পড়ল চাপা আতঙ্কের ছবিই। গ্রামের ভিতরে পা দিতেই দুবরাজপুর প্রাথমিক স্কুল। পিছনে বেশ কয়েকজন যুবক মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। কাছে যেতে বোঝা গেল ফেসবুকে ব্যস্ত তাঁরা। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি বুঝতে পেরেই যেন সাবধান হয়ে গেলেন ওঁরা। সবার মুখেই একই কথা, “ডাইন বলে যে কিছু নেই, তা আমরা পাড়ায় সব বলে দিয়েছি। এখন ওই সব নিয়ে আর কোনও সমস্যা নেই। এখন একটাই চিন্তা গ্রামের মানুষগুলি কবে বাড়ি ফিরবে’’ সাবধানী গলাও হঠাৎ উদাস হয়ে যায়।

এ গ্রামে প্রায় প্রত্যেক পরিবারেরই কেউ না কেউ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জড়িত ছিলেন। তাঁদের কেউ এখন জেলে। কেউ বা পলাতক। ফলে সকলের উদ্বেগ ওই একই জায়গায়— কবে ফিরবে মানুষগুলো!

সে দিন ‘ডাইন নিধনে’ পিছপা হয়নি কেউ। জানগুরুর নিদান মেনে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঁশ হাতে তুলে নিয়েছিল। নিরপরাধ তিন মহিলার শেষ নিঃশ্বাসটুকু বেরিয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত তাদের হাত থামেনি।

দুবরাজপুরের গ্রামে সেই সময় এক এক করে অনেকে সর্দি-জ্বরে ভুগছিলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে গ্রামের মানুষ গিয়েছিলেন ৬৫ কিলোমিটার দূরে গড়বেতার আনন্দনগরে। জানগুরু সমাই মাণ্ডি থাকত সেখানেই। সমাই মাণ্ডিই নিদান দেয় গ্রামের বৃদ্ধা ফুলমণি সিংহ (৬২) ও তাঁর মেয়ে শম্বারী সিংহ(৪০) এবং তাঁদের পড়শি হরিরাজপুর গ্রামের অন্য এক মহিলা শম্বরী সিংহ (৫৫) ডাইনি হয়েছেন। তার ফলেই গ্রামে এত অসুখ-বিসুখ।

২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর রাতে গ্রামের সিংহপাড়ায় বসে সালিশি। ফতোয়া দেওয়া হয় ওই তিন মহিলাকে গ্রাম ছাড়তে হবে, সঙ্গে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা। না-হলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। মাতব্বরদের নির্দেশ শুনেই ফুলমণিদেবীর ছেলে বুধু সিংহ, জামাই লক্ষ্মীকান্ত ও শম্বরীর স্বামী বোবা সিংহেরা প্রতিবাদ করেন। ফল হয় উল্টো। ওই তিন পুরুষকেই ভয় দেখিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তার পর নির্বিঘ্নে শুরু হয় মারধর। তিন মহিলাকে মারতে মারতে গ্রাম লাগোয়া কংসাবতীর চরে নিয়ে আসেন বাসিন্দারা। ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনজনই। দেহগুলি বিবস্ত্র করে চরে পুঁতে দেওয়া হয়।

পরদিন সকালেই এলাকায় পৌঁছে যায় পুলিশ। মৃত শম্বারীর স্বামী লক্ষ্মীকান্ত সিংহের লিখিত অভিযোগে দাসপুর থানার পুলিশ তদন্তে নামে। শুক্রবার ঘাটাল আদালতে সরকারি আইনজীবী কৃষ্ণেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘ঘটনায় মোট ৪৯ জনের নামে এফআইআর করা হয়। বেশিরভাগই মহিলা। পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ২২জন। বাকিরা এখনও পলাতক।’’ ঘটনার মাস তিনেকের মধ্যেই চাজর্শিট জমা পড়ে। শুরু হয় বিচার। বিচার চলাকালীন দু’জনের মৃত্যুও হয়। চারজন জামিনে মুক্তি পেলেও বাকিরা জেলেই ছিলেন। ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় ওই মামলায় অভিযুক্তরা দোষী সব্যস্ত হল।

দিন দশেক আগেই রায় বেরনোর খবর জেনে গিয়েছিলেন দুবরাজপুরের বাসিন্দারা। দাসপুর শহর প্রায় প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে ওই গ্রামে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল শম্ভু সিংহের সঙ্গে। ফুলমণি দেবীর আত্মীয় শম্ভু সিংহই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন কংসাবতীর চরে পোঁতা তিনটি দেহ। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তিনি একটু বেশি স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন, “ওই ঘটনার পর গ্রামের হাল অনেকটাই ফিরে গিয়েছে। গ্রামে এখন কারও সঙ্গে কোনও বিবাদ নেই। কারও মুখে ডাইন শব্দটাও বের হয়নি আর। এলাকায় আত্মীয়দের আনাগোনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”

আত্মীয়দের যাতায়াত বন্ধ হল কেন? প্রশ্ন করতেই শম্ভু সিংহকে চুপ করিয়ে দিলেন কাকলি সিংহ, অঞ্জলি সিংহরা। উত্তর দিলেন তাঁরাই, “একটা অন্ধ কুসংস্কার আমাদের গোটা গ্রামকে শেষ করে দিয়েছে! আমাদের সমাজে এখনও জানগুরুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাই আত্মীয়েরা এলেই ফের ওই চর্চা শুরু হবে। আমরা চাই না।” দুবরাজপুরে বাসিন্দারা এখন নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়েও সতর্ক। গ্রামের মধ্যে নিজেরাই সেরে নেন সে সব আচার। কারণটা সেই একই।

কাকলিদেবীর কথায়, “আমার ছেলেটা জেলে পচছে। জানি না কী হবে।” অঞ্জলিদেবীর বলেন, “ওই ঘটনায় আমার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলাম। আমার মেয়ের মুখটাও দেখেননি আমার স্বামী। ওই ভুল যদি না হতো তাহলে কী মেয়েকে কোলে নিয়ে আমাকে লোকের বাড়িতে কাজে যেতে হতো?’’ বছর তেইশের যুবক রাজু সিংহও বললেন একই কথা, “আমাদের ভুল বুঝিয়েই জানগুরু ও মাতব্ব‌রেরা এমন কাণ্ড ঘটালো। আমার দেড় বছরের ছেলে-সহ স্ত্রীকে জেল খাটতে হচ্ছে। কতদিন ওদের দেখিনি।’’

শাস্তি হয়েছে আদালতের রায়ের আগেই। আতঙ্কে হোক, অনুশোচনায় হোক সম্বিৎ ফিরেছে গ্রামের মানুষগুলোর। স্থানীয় বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক শিবশঙ্কর শাসমল বলেন, “ঘটনার পর পুলিশ-প্রশাসনের উদ্যোগে দু’বার সচেতনতা শিবির হয়েছিল। আর হয়নি। তবে আর প্রয়োজনও নেই। গ্রামের সিংহপাড়ার সবাই এখন জানেন বিষয়টি যে নিছকই কুসংস্কার।” কিন্তু এত কিছুর পরও জানগুরু সিধে হয়েছেন বলে মনে হয় না। শুক্রবার এজলাসে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। কুসংস্কার পুষে রাখাই যার পেশা, সেই সমাই মাণ্ডি দেদার আইন সচেতন। মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে সমাই বলে, ‘‘আমি পুলিশ হেফাজতে। আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন না। আমি কিছু বলব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

women killed witch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE