জলের খোঁজে। বেলপাহাড়িতে দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
ভোরের আলো ফুটতেই জলের খোঁজ!
অবাক লাগলেও এটাই এখন বেলপাহাড়ির কল্পনা রুইদাস, পুতুল মণ্ডলদের নিত্যদিনের কাজ। তীব্র গরমে ফুটিফাটা মাঠ। চড়চড় করে বাড়ছে তাপমাত্রা। নলকূপ থেকেও মিলছে না জল। তাই সকাল হতেই হাঁড়ি-কলসি নিয়ে জলের প্রতীক্ষা।
বেলপাহাড়ির পাহাড়ি এলাকার গ্রামগুলিতে খাল, বিল শুকিয়ে ফুটিফাটা। সমতল এলাকাগুলিতেও পানীয় জলের আকাল দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেলপাহাড়ির ১৪টি এলাকায় একাধিক ট্যাঙ্কার-গাড়িতে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার লিটার জল পাঠাচ্ছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। সেটাও পর্যাপ্ত নয়। জলের দাবিতে প্রায়ই ক্ষোভ-বিক্ষোভ হচ্ছে।
কল্পনা রুইদাস বলছেন, ‘‘তীব্র গরমে কুয়োর জলস্তর নেমে গিয়েছে। নলকূপ টিপে টিপে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। নলকূপ দিয়ে জল বেরোচ্ছে না। মাঠঘাট ফুটিফাটা। বাইরে থেকে আসা গাড়ির জলই ভরসা।’’ একইভাবে পুতুলদেবীও বলেন, ‘‘সকাল হতেই জলের জন্য বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। জল ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না।’’ বেলপাহাড়ির এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ভোটের আগে নেতারা এসে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ভোট মিটলেই যে কে সেই। আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না।’’
বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায় পানীয় জল সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। নব্বইয়ের দশকে বেলপাহাড়ির ৪৫ টি মৌজায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য তারাফেনি খালের জলভিত্তিক নলবাহিত একটি জলপ্রকল্প চালু হয়। কিন্তু ওই পুরনো প্রকল্পের সব ট্যাপে জল মেলে না বলে অভিযোগ। গরম পড়লেই তারাফেনি খালে জলের সরবরাহ কমে গিয়ে পরিশোধিত জল সরবরাহে ভাঁটা পড়ে।
সমস্যা মেটাতে সম্প্রতি বেলপাহাড়ির বড়শুকজোড়ায় একটি নতুন জলপ্রকল্পের কাজ হয়েছে। ভোটের আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ঘটা করে নতুন প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন রাজ্যের বিদায়ী মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন প্রকল্পে বেলপাহাড়ির আরও ৩৯টি মৌজায় ১১০টি ট্যাপ কলের মাধ্যমে নলবাহিত পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হবে। কিন্তু উদ্বোধনই সার। প্রায় দু’মাস হতে চলল, এখনও নতুন প্রকল্পটিতে জল সরবরাহ শুরু হয়নি।
জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে দাবি, তারাফেনি খালে পর্যাপ্ত জল না থাকায় নতুন প্রকল্পটির জলাধারে জল সঞ্চয় করা যায়নি। তাই পুরনো প্রকল্পের মাধ্যমে জল সরবরাহ চললেও নতুন প্রকল্পটি চালু করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে জলের সঙ্কট-কবলিত এলাকায় জনস্বাস্থ্য করিগরি দফতরের ট্যাঙ্কার-গাড়ি পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এ ভাবে জলের গাড়ি পাঠিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার জলের সঙ্কট যে মেটানো সম্ভব নয়, তা মানছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের আধিকারিকরা।
বেলপাহাড়ির সমতল এলাকার শিলদা, নারানপুর, কুড়চিবনি, সাহাড়ি, খামার, পড়াশিডাঙা, কুচলাপাহাড়ি, ছোটজামশোল, গণ্ডাপালের মতো এলাকাগুলিতে জলের হাহাকার শুরু হয়েছে। ইতিপূর্বে পানীয় জলের দাবিতে বেলপাহাড়িতে একাধিক বার পথ অবরোধও করেছেন বাসিন্দারা। শুক্রবারও ফের কুড়চিবনি এলাকায় পানীয় জলের দাবিতে পথ অবরোধ হয়।
বিদ্যুতের কম ভোল্টেজের জন্য লালগড়েও পানীয় জল সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। ফলে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জলোত্তলন প্রকল্পের পাম্পগুলি কার্যত চালানোই যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার তরফে অবশ্য আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, লালগড়ে বিদ্যুতের সাব স্টেশন তৈরি হলে কম ভোল্টেজের সমস্যা আর থাকবে না। কিন্তু সাব স্টেশন তৈরির জন্য এখনও সরকারি স্তরে অনুমোদন মেলেনি।
বেলপাহাড়ি ও লালগড়ের বাসিন্দারা বলছেন, ভোটের আগে পানীয় সমস্যা সমাধানের নানা আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রার্থীরা। ভোটের পরে এখন আর তাঁদের টিকি দেখা যাচ্ছে না। বেলপাহাড়ি ব্লকটি বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম বলেন, “যেখানেই প্রচারে গিয়েছি জলের সমস্যা নিয়ে বাসিন্দাদের অভিযোগ শুনেছি। বিধায়ক হলে জলের সমস্যা মেটানোর জন্য আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করব।” লালগড় ব্লক ঝাড়গ্রাম বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। ঝাড়গ্রামের বিদায়ী বিধায়ক তথা তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার হাঁসদা বলেন, “পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে থাকাকালীন অনেক জলপ্রকল্প করেছি। আগামী দিনেও এ বিষয়ে নজর দেব।”
এ নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “পানীয় জলের সমস্যা মেটানোর জন্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বেশ কিছু জল প্রকল্প তৈরির জন্য রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব জমা দেওয়া আছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy