Advertisement
২০ মে ২০২৪

চিন্তা নেই, পাশে আছেন বিষ্ণুস্যার

অভাবের তাড়নায় নিজে স্কুল ফাইনালের পর আর পড়তে পারেননি। কিন্তু সেই অভাব যাতে আর কারও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য সদা তৎপর তিনি। আর এ কারণেই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় দুঃস্থ মেধাবী পড়ুয়াদের সাহায্য করতে ছুটে চলেছেন বিষ্ণুপদ রায়। গত দু’দশক ধরে শতাধিক দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ জুগিয়ে চলেছেন ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা ‘বিষ্ণুস্যার’।

বিষ্ণুপদ রায়। —নিজস্ব চিত্র।

বিষ্ণুপদ রায়। —নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০১:০৩
Share: Save:

অভাবের তাড়নায় নিজে স্কুল ফাইনালের পর আর পড়তে পারেননি। কিন্তু সেই অভাব যাতে আর কারও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য সদা তৎপর তিনি। আর এ কারণেই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় দুঃস্থ মেধাবী পড়ুয়াদের সাহায্য করতে ছুটে চলেছেন বিষ্ণুপদ রায়। গত দু’দশক ধরে শতাধিক দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ জুগিয়ে চলেছেন ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা ‘বিষ্ণুস্যার’।

অরণ্যশহরের কেশবডিহি এলাকার বাড়িতে একাই থাকেন বিষ্ণুপদবাবু। ব্যক্তিগত কারণে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে অনেক বছর আগে। একমাত্র ছেলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক চিকিৎসক। বর্তমানে প্রতি মাসে ২৮ জন দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীর উচ্চ শিক্ষার খরচ জোগাচ্ছেন বিষ্ণুপদবাবু। আর তাই খাদ্য দফতরের সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও ৭৮ বছর বয়সে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের বিমা সংস্থায় এজেন্টের কাজ করছেন তিনি। এখন প্রতি মাসে নিজের পেনসন, রোজগার ও সঞ্চিত টাকার সুদের সিংহভাগটাই খরচ হয়ে যায় রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা দুঃস্থ পড়ুয়াদের
উচ্চশিক্ষার জন্য।

কেন এমন উদ্যোগ? সেই কথা বলতে গিয়ে বিষ্ণুবাবু ফিরে যান নিজের ছোটবেলায়। জানান, অসুস্থ বাবা ও মায়ের হাত ধরে ’৫৫ সালে রুজির খোঁজে ঝাড়গ্রাম শহরে চলে আসেন তাঁরা। ছিটেবেড়ার ঘরে কোনও মতে মাথা গোঁজার জায়গা হয়। মুড়ি ভেজে কোনও মতে বিষ্ণুপদবাবুর পড়াশুনার খরচ জোগাতেন তাঁর মা রাজবালাদেবী। ১৯৫৭ সালে ঝাড়গ্রাম ননীবালা বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করেন বিষ্ণুপদবাবু। টাকার অভাবে আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। সংসার চালানোর হন্যে হয়ে চাকরির খোঁজ শুরু করেন। খাদ্য দফতরে পিওনের চাকরি জুটে যায়। বিষ্ণুপদবাবুর কথায়, “চাকরি পাওয়ার পরেই শপথ নিই সাধ্যমতো দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ জোগাব। সেই শুরু।’’ প্রতি বছর মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিষ্ণুপদবাবু। খবরের কাগজের পাতায় দুঃস্থ মেধাবীদের খবর প্রকাশিত হলে ছুটে যান সেই স্কুলে। খোঁজ নিয়ে পৌঁছে যান কৃতীর কাছে। কী ভাবে আসে এই টাকা? বিষ্ণুপদবাবুর জবাব, “প্রতি মাসে পেনশন পাই ১৫ হাজার টাকা। গচ্ছিত টাকার সুদ থেকে মাসিক ১২ হাজার টাকা পাই। আর বাকিটা জোগাড় হয় বিমার কমিশন থেকে।’’

বিষ্ণুপদবাবুর থেকে সাহায্য পেয়েছেন এমন পড়ুয়ার সংখ্যা কম নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের (বাংলা এমএ) স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র বিনপুরের ষাঁড়পুরা গ্রামের সুমন্ত মণ্ডল জানিয়েছে, “উচ্চ মাধ্যমিকের পরে টাকার অভাবে পড়াশুনা বন্ধ হতে বসেছিল। খবর পেয়ে বিষ্ণুস্যার প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে গিয়েছেন।” আইআইটি কানপুরের এম টেকের ছাত্র খেজুরির অরিজিত্‌ মহাপাত্রের কথায়, ‘‘বিষ্ণুস্যার সাহায্য না করলে শিবপুরে বি-টেক পড়তেই পারতাম না। স্কলাপশিপ পেয়ে এখন এমটেক করছি। ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ।” খড়্গপুর আইআইটিতে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করছেন অরিজিতের বন্ধু প্রতাপ পণ্ডা। তাঁর কথায়, “স্কুলের এক শিক্ষকের মাধ্যমে বিষ্ণুস্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এই পর্বে ওঁর সাহায্য ও আন্তরিকতা ভোলার নয়।”

বাবার এমন কাজে খুশি ছেলেও। সিদ্ধার্থবাবুর কথায়, “বাবা নিজের শেষ সম্বলটুকুও দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য খরচ করছেন। এমন বাবার ছেলে হয়ে আমি গর্বিত।” আর বিষ্ণুপদবাবু বলেন, ‘‘আমি কোনও কিছু পাওয়ার জন্য তো করি না। ওদের সাফল্যের হাসিতেই আমার আনন্দ। একশো বছর বেঁচে আরও অনেক গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যত্‌ গড়ার শরিক হতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bishnu Rai Jhargram kingshuk aich school final
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE