Advertisement
০২ মে ২০২৪

চালু হয়নি রক্তের ইউনিট, ভোগান্তি

দিন কয়েক আগে বৌদির জন্য রক্তের প্রয়োজন পড়ে ডেবরার বাসিন্দা প্রদীপ জানার। অস্ত্রোপচারের জন্য দ্রুত পাঁচ বোতল রক্তের দরকার ছিল। হন্যে হয়ে মেদিনীপুর ও খড়্গপুরের বিভিন্ন ব্লাডব্যাঙ্কে ঘুরেও রক্ত মেলেনি। শেষে রক্তদাতা জোগাড় করে কোনও ক্রমে দু’বোতল রক্ত জোগাড় হয়। প্রদীপবাবুর কথায়, “আরও তিন বোতল রক্তের জন্য বহু ঘুরেছি। কিন্তু রক্তদাতাও পাইনি আর রক্তও পাইনি।”

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

দিন কয়েক আগে বৌদির জন্য রক্তের প্রয়োজন পড়ে ডেবরার বাসিন্দা প্রদীপ জানার। অস্ত্রোপচারের জন্য দ্রুত পাঁচ বোতল রক্তের দরকার ছিল। হন্যে হয়ে মেদিনীপুর ও খড়্গপুরের বিভিন্ন ব্লাডব্যাঙ্কে ঘুরেও রক্ত মেলেনি। শেষে রক্তদাতা জোগাড় করে কোনও ক্রমে দু’বোতল রক্ত জোগাড় হয়। প্রদীপবাবুর কথায়, “আরও তিন বোতল রক্তের জন্য বহু ঘুরেছি। কিন্তু রক্তদাতাও পাইনি আর রক্তও পাইনি।”

একই অভিজ্ঞতা হয় ডেবরার বাসিন্দা ডেবরার বাসিন্দা দিলীপ সাঁই বলেন, “রক্তের প্রয়োজন পড়লে খড়্গপুর-মেদিনীপুরে ছুটে বেড়াতে হয়। তারপরেও রক্ত মেলেনা। আমাদের এখানে একটি ব্লাডব্যাঙ্ক খুব প্রয়োজন।” দাঁতনের মনোহরপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গৌরীশঙ্কর মিশ্রেরও বক্তব্য, “এখানে ব্লাডব্যাঙ্ক না থাকায় রক্তের প্রয়োজন পড়লে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে খড়্গপুরে ছুটতে হয়। সেখানে গিয়েও রক্ত পাওয়া না গেলে রক্তদাতা দিতে হয়।”

মুমূর্ষু রোগীদের জন্য রক্তের প্রয়োজন হলেও অনেক সময় তা মেলে না বলে অভিযোগ। পরিস্থিতি দেখে বছর কয়েক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের ৬টি গ্রামীণ হাসপাতাল- ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ‘ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট’ গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যদিও এখনও পর্যন্ত মাত্র একটি গ্রামীণ হাসপাতালে এই ইউনিট চালু সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫টিতে হয়নি। কবে হবে সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর নেই জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে।

পশ্চিম মেদিনীপুরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি খড়্গপুর ও ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালেও ব্লাড ব্যাঙ্ক রয়েছে। ব্লাড ব্যাঙ্ক রয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালেও। যদিও গরম পড়লেই ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোয় রক্তের চরম সঙ্কট দেখা দেয়। এক ইউনিট রক্তের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখা যায় রোগীর পরিজনদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্য জেলা মিলিয়ে মোট ২৯টি ব্লক। জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। যদিও এর জন্য জেলার চারটি ব্লাড ব্যাঙ্ক যথেষ্ট নয়। সেই কারণেই চন্দ্রকোনা, সবং, গড়বেতা, নয়াগ্রামের খড়িকামাথানি, গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের তপসিয়া ও বেলদায় ‘ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট’ গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। জেলার এক স্বাস্থ্য- কর্তা বলেন, “সবংয়ে এই ইউনিট গড়ে ওঠার কথা। এখন সবং, পিংলা, নারায়ণগড় ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ রক্তের জন্য খড়্গপুরে আসেন। খড়্গপুরে রক্ত না- পেলে মেদিনীপুরে এসে খোঁজখবর করেন। সবংয়ে ওই ইউনিট চালু হলে মানুষকে আর খড়্গপুর- মেদিনীপুরে আসতে হবে না।”

কী থাকার কথা এই ইউনিটে? জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রে খবর, প্রতিটি ইউনিটে একজন করে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (এম টি) এবং একজন করে মেডিক্যাল অফিসার (এম ও) থাকবেন। প্রতিটি গ্রুপের অন্তত দুই ইউনিট করে রক্ত থাকবে। যদিও এখনও শুধুমাত্র চন্দ্রকোনা গ্রামীণ হাসপাতালেই এই ইউনিট চালু করা সম্ভব হয়েছে। পরিকাঠামোগত নানা সমস্যার জন্য বাকিগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা শুধু বলেন, “ন্যূনতম যে সব পরিকাঠামো জরুরি, সেগুলো দ্রুত গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তারপরই প্রস্তাবিত ইউনিটগুলো চালু হবে।” অথচ, এই ইউনিটগুলো চালু হলে অনেকেই উপকৃত হতেন।

ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট না থাকায় সমস্যায় পড়েন কয়েক হাজার রোগী। ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতালের কথাই ধরা যাক। ডেবরা ছাড়াও আশপাশের সবং, পিংলা, খড়্গপুর গ্রামীণ, কেশপুর থেকেও বহু রোগী এখানে আসেন। শয্যা রয়েছে ৪০টি। অথচ, সবসময় গড়ে ৬০-৬৫ জন। অগত্যা শয্যার অভাবে একাংশ রোগীকে মাটিতেই থাকতে হয়! ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হওয়ার পর এই হাসপাতালকে ‘ফাস্ট রেফারেল ইউনিট’ বলে চিহ্নিত করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। সেই মতো জানানো হয়, সবং- পিংলা থেকে কোনও রোগীকে ‘রেফার’ করতে হলে শুরুতে ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতালেই ‘রেফার’ করতে হবে। কিন্তু, কোথায় কী! গ্রামীণ হাসপাতালের যে পরিকাঠামো থাকা জরুরি, ডেবরায় তা গড়ে তোলা হয়নি বলেই অভিযোগ। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক মানছেন, “স্থানীয় গ্রামীণ হাসপাতালে এই ইউনিট থাকা সত্যিই জরুরি।”

অনেক সময় খড়্গপুর-মেদিনীপুরে এসেও রক্ত মেলে না। কারণ, মাঝেমধ্যেই জেলায় রক্তের সঙ্কট চলে। কেন? জানা গিয়েছে, আগের থেকে এখন রক্তদাতার সংখ্যা কমেছে। এক সময় যেখানে শিবির পিছু গড়ে ৬০ জন রক্ত দিতেন, এখন সেখানে ৪০ জন রক্ত দেন। পরিস্থিতি দেখে মেদিনীপুর মেডিক্যালে রক্তের উপাদান পৃথকীকরণের (কম্পোনেন্ট সেপারেশন) ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তাতেও সব সুরাহা হয়নি। মেডিক্যালের এক কর্তাও বলেন, “এখন শিবিরের সংখ্যা কমেছে। সেই ভাবে শিবির হচ্ছে না। ফলে, সমস্যা দেখা দিয়েছে। শিবিরের সংখ্যা বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।”

বিরোধীদের অভিযোগ, ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোর পরিকাঠামোগত উন্নতিই করেনি তৃণমূল সরকার। সিপিএম নেতা দীপক সরকারের খোঁচা, “জেলার ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোয় নীল-সাদা উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি!” বিজেপি নেতা তুষার মুখোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “খেলা-মেলা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে তৃণমূল সরকার উদাসীনই থেকেছে!” তৃণমূল নেতা দীনেন রায় অবশ্য বলেন, “ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোর পরিকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যালে রক্তের উপাদান পৃথকীকরণের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এরফলে, এক ইউনিট রক্ত একাধিক রোগীকে দেওয়া যাচ্ছে।” কবে প্রস্তাবিত ওই পাঁচটি গ্রামীণ হাসপাতাল- ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ‘ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট’ চালু হয়, সেটাই দেখার!

(সহ প্রতিবেদন: দেবমাল্য বাগচী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE