Advertisement
E-Paper

ভাঙনের আশঙ্কায় রাত জাগে মন্দারমণি

চায়ের দোকানে বসে ঢুলছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ জানা। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলেন। এক ভাঁড় চা খেতে খেতেই তোলা হল প্রসঙ্গটা। দোকানের ঢিল ছোঁড়া দূরেই সমুদ্র। ঢেউ আছড়ে পড়ছে দোকানের গা বরাবর।

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:২২
ভাঙছে সৈকত। সোহম গুহর তোলা ছবি।

ভাঙছে সৈকত। সোহম গুহর তোলা ছবি।

চায়ের দোকানে বসে ঢুলছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ জানা। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলেন। এক ভাঁড় চা খেতে খেতেই তোলা হল প্রসঙ্গটা। দোকানের ঢিল ছোঁড়া দূরেই সমুদ্র। ঢেউ আছড়ে পড়ছে দোকানের গা বরাবর। ভাঙনের ভয় করে না? হেসে উত্তর লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর, ‘‘রাতে জেগে বসে থাকি, বিশ্বাস করুন! মন্দারমণিতে আমরা তো দুয়োরানি। আমাদের কথা কে আর ভাবছে?”

সৈকতপাড়ে ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনেই নিউ জলধা গ্রাম। স্থানীয় মৎস্যজীবী গ্রাম হিসেবেই মূলত পরিচিতি এই গ্রামের। অমাবস্যা-পূর্ণিমা এলে আতঙ্কে রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না গ্রামবাসীরা। দিনকয়েক আগেই সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে গ্রামের বেশ কিছু অংশ সমুদ্রগর্ভে চলে গেছে। গ্রামের শ্রীকান্ত বর, শেখ কাসেম, ভারতী জানা, লক্ষ্মীনারায়ণ জানা, ক্ষুদিরাম বরদের চোখেমুখে এখনও সমুদ্র গ্রাসের আতঙ্কের ছাপ। সমুদ্র ভাঙনের ফলে গত কয়েক দশক ধরে নিউ জলধার মৎস্যজীবীদের চিরাচরিত জীবন-জীবিকাও সঙ্কটের মুখে। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, এ বিষয়ে হেলদোলই নেই প্রশাসনের।

গত কয়েক দশক ধরে নিউ জলধা-সহ মন্দারমণি মৌজার মানুষদের কাছে সৈকতই যাতায়াতের একমাত্র পথ। প্রতিদিন সমুদ্রের জোয়ারের জলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা মন্দারমণি মৌজা। সৈকত ছাড়া রাস্তা না থাকায় জোয়ারের সময় বাইরের জগৎ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই থাকেন স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। সৈকত ছাড়া যাতায়াতের বিকল্প রাস্তা এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি প্রশাসন। মন্দারমণি এলাকার দাদনপাত্রবাড়, সিলামপুর আর মন্দারমণি মৌজা পর্যন্ত প্রায় ৯ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত ধরে এগোলেই চোখে পড়বে উপকূল ভাঙনের ধ্বংসের চেহারা। সৈকতের যেখানে সেখানে বালি উঠে গিয়ে কাদা বেড়িয়ে পড়ছে। কার্যত সৈকতের উপরে গজিয়ে উঠা হোটেল রিসর্টগুলোতে ভাঙন ঠেকাতে ফেলা রাখা বোল্ডারের স্তূপ আর সৈকতজুড়ে সমুদ্র ভাঙনের ধ্বংসের ছবি। মন্দারমণির সমুদ্রপাড় ভেঙে এগিয়ে আসছে সমুদ্র। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে ভাঙন রোধে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সোনামুই গ্রামের বাসিন্দা শেখ রাজেশউদ্দিনের অভিযোগ, ‘‘সমুদ্রপাড় ভাঙতে ভাঙতে সমুদ্র তো এখন বাড়ির দোড়গোড়ায়। যে কোন দিন বাড়িঘর তলিয়ে যাবে। জানি না কী আছে কপালে!’’

মন্দারমণির সৈকতে অবৈধভাবে হোটেল রিসর্ট গজিয়ে উঠায় উপকূলের বাস্তুতন্ত্রর ক্ষয়িষ্ণু চেহারা দেখে চমকে উঠেছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরাই। মন্দারমণি-সহ পূর্ব মেদিনীপুর ও ওড়িশা উপকুলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাত বছরের বেশী সময় ধরে গবেষণা করছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও বনবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অমলকুমার মণ্ডল। অমলবাবুর কথায়, “মন্দারমণি সমুদ্র সৈকতে অবৈধ নির্মাণ, সৈকতের উপর দিয়ে মোটরযান চলাচলের জেরে মন্দারমণির উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভূমিক্ষয় ছাড়াও জীববৈচিত্র্যও হ্রাস পাচ্ছে। আবার কোথাও সৈকতের উপরেই যে ভাবে হোটেল রিসর্ট গড়ে তোলার জন্য নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, সেটাও এই ভাঙনকে ত্বরান্ত্বিত করছে।’’ তিনি আরও জানান, সমুদ্রতীরের ভূমিক্ষয় –রোধকারী দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ‘আইপোমিয়া বাইলোবা’ ও ‘স্পিনিফেক্স স্কোয়ামোসাস’। অমলবাবু বলেন, ‘‘সৈকতের বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা এই দু’টি গাছ ভূমিক্ষয় রোধে ৬০-৭০ শতাংশ সহায়ক। আর অবৈধ নির্মাণ গড়ে তুলতে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে এই গাছ। প্রশাসনের এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত।’’

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চের সহযোগী অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ির কথায়, ‘‘সৈকতের উপর দিয়ে যান চলাচলের ফলে অনেক জায়গায় বালি সরে কাদা বেরিয়ে পড়েছে। ভাঙন ঠেকানোর নামে সৈকতের উপরে হচ্ছে পাঁচিল। হোটেল লজগুলির যাবতীয় আবর্জনা ও নোংরা জও নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে সৈকতে। এর জেরে হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের লাল কাঁকড়া।” বিজ্ঞানীরা বলছেন, “পযর্টন শিল্পের নামে সৈকত জুড়ে যেভাবে প্রকৃতি সংহার চলছে তা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি জন-সচেতনতা বাড়ানোও দরকার। না হলে সৈকতটাই সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে।”

দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের সহ সভাপতি ও রামনগরের তৃণমূল বিধায়ক অখিল গিরি বলেন, ‘‘ভাঙন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেচ দফতরের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ব্ল্যাক স্টোন দিয়ে পাড় বাঁধাইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। কাজের অনুমোদন মিললেই কাজ
শুরু হবে।’’

Erosion mandarmani
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy