১২টি প্ল্যাটফর্মের খড়্গপুর স্টেশনে একই সময়ে এসে হাজির মেদিনীপুর-হাওড়া লোকাল ও ঘাটশিলা-হাওড়া মেমু। ফুটওভারব্রিজে তখন অপেক্ষায় ইস্পাত এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। থিক-থিক করছে লোক। সিঁড়ি-লিফট-চলমান সিঁড়ি, যে যে পথে পারছেন, গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যস্ত। শেষ সময়ে ঘোষণা, স্টেশনে ঢুকছে ইস্পাত এক্সপ্রেস। ব্যাস, আর রক্ষে নেই। ৫ ও ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওঠা-নামায় ব্যস্ত যাত্রীদের ভিড়ে ফুটব্রিজ যেন কাঁপছে। ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে এক মহিলা বললেন, “এখানেও তো মানুষ মরবে দেখছি!”
মুম্বইয়ের এলফিনস্টোন স্টেশনের ঘটনা এখনও টাটকা। ওই ঘটনার পরই দেশ জুড়ে যাত্রী নিরাপত্তায় প্ল্যাটফর্ম ও ফুটব্রিজগুলিতে বিশেষ নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। বাস্তব হল দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ‘এ-ওয়ান’ স্টেশন খড়্গপুরে প্রতিদিনই এ ভাবে সংকীর্ণ ফুটব্রিজে নাকাল হতে হয় যাত্রীদের। আর উৎসবের ভিড়ে তো সমস্যা চরমে পৌঁছয়। বহু পুরনো এই ফুটব্রিজে উঠতে লিফট ও চলমান সিঁড়ি রয়েছে। তবে ফুটব্রিজের উপরের অংশ সঙ্কীর্ণ। আর সেখানেই যাত্রীর চাপ সব থেকে বেশি। লিফট, চলমান সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে সবাই তো ওখানেই নামছেন। ভিড়ে চলাফেরার সময় ধাক্কাধাক্কিতে অশান্তি বাধছে। অনেক সময় ভিড়ে ঠাসা ফুটব্রিজ থেকে নামতে না পেরে ট্রেন হাতছাড়া হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলা যাত্রীরা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বেঙ্গল-নাগপুর রেলের অধীনে গড়ে ওঠা দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ঐতিহ্যবাহী জংশন স্টেশন এই খড়্গপুর। ১৮৯৯ সালে গড়ে ওঠা স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। ব্রিটিশ জমানায় বিংশ শতকের গোড়ায় মালগুদামের দিক থেকে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছতে একটি ফুটব্রিজ ছিল। তা বেহাল হয়ে পড়ায় ১৯৭৬ সাল নাগাদ বোগদা থেকে মালগুদাম পর্যন্ত পুরনো ফুটব্রিজের পশ্চিমাংশে নতুন ফুটব্রিজ গড়া হয়। কিন্তু তা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় বরাবরই যাতায়াতে সমস্যা হত।
এখন দিনে প্রায়য় ৩৫ হাজার মানুষ এই স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করেন। রয়েছে ১২টি প্ল্যাটফর্ম। ফলে, ভিড়ে প্রায় ৪০ বছরের পুরনো ফুটব্রিজ আরও জীর্ণ হয়েছে। যাত্রীদের চলাফেরায় তা কাঁপেও। ফুটব্রিজে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা হাউরের বৃদ্ধ অজিত সামন্ত বলেন, “চাষের কাজে নানা সময়ে খড়্গপুরে আসি। একটা ট্রেন এলেই ভিড়ে এই ফুটব্রিজ এত কাঁপে যে ভয় লাগে। ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হয়।” খড়্গপুরের বুলবুলচটির বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক নরেন্দ্রনাথ চন্দেরও বক্তব্য, “ফুটব্রিজটি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। একসঙ্গে দু’টি ট্রেন এলে চলা দায়।”
ফুটব্রিজের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও সম্প্রসারণের দাবি বহুদিন ধরেই জানাচ্ছেন যাত্রীরা। কিন্তু রেল সূত্রে খবর, খড়্গপুরের মতো ‘এ-ওয়ান’ স্টেশনে ফুটব্রিজ ভেঙে নতুন করে গড়া কার্যত অসম্ভব। কারণ, এর সঙ্গে লিফট, চলমান সিঁড়ি সংযুক্ত রয়েছে। তাছাড়া, ফুটব্রিজ ভাঙা হলে ১২টি প্ল্যাটফর্মে যাতায়াত কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় একটি ফুটব্রিজ গড়লে সমস্যা কিছুটা কাটবে বলে ধারণা ছিল রেলের। সেই মতো বছর খানেক আগে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ফুটব্রিজ গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও সে কাজ শুরুই হয়নি। তাই যাত্রীদের দুর্ভোগ চলছে।
খড়্গপুরের পুরপ্রধান তথা তৃণমূল শহর সভাপতি প্রদীপ সরকার বলেন, “বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিধায়ক হওয়ার পর থেকে ভাঁওতাবাজি চলছে। রেল প্রতিমন্ত্রী এসে বলছেন, বিশ্বমানের স্টেশন হবে, কিন্তু আমরা কিছুই দেখতে পারছি না।” বিজেপি বিধায়ক দিলীপ ঘোষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তুষার মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “দিলীপদা এক বছর হল জিতেছেন। উনি রেলের উন্নয়নে চেষ্টা চালাচ্ছে। নিশ্চয় উন্নয়ন হবে।” আর খড়্গপুরের এডিআরএম মনোরঞ্জন প্রধানের আশ্বাস, “খড়্গপুর স্টেশনের সমস্যার কথা ভেবেই আমরা দ্বিতীয় একটি ফুটব্রিজ গড়ার প্রকল্প তৈরি করেছি। মাস ছ’য়েকের মধ্যেই নতুন ফুটব্রিজ হয়ে যাবে।”