সময়টা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তত্কালীন অবিভক্ত বাংলায় মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চল, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পাবনা ও খুলনায় একের পর এক নীলকুঠি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি আগুনে পুড়ছে। অথচ সেই বিদ্রোহের কোনও আঁচ লাগেনি পশ্চিম সীমান্তে বাংলার পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা বেলপাহাড়ির শান্ত জনপদের গায়ে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা তখন দুর্ভেদ্য। স্থানীয় বাসা পাড়ায় নীলকুঠিতে রীতিমতো নীল তৈরির ভাটিখানা চলত। বেলপাহাড়ির বাসা পাড়ায় অতীতের সাক্ষী সেই নীলকুঠি এখন কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে নীল তৈরির চিমনি-সহ প্রস্তুতিকরণ ঘরটিও ভগ্নপ্রায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দেড়শো বছরের পুরনো নীলকুঠি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনিক স্তরে আজ পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ভূমি দফতরের পুরনো নথি থেকে জানা যায়, বেলপাহাড়ি, ভেলাইডিহা, সন্দাপাড়া, ভুলাভেদা, শিমুলপাল ও বাঁশপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে এক সময় নীল চাষ হত। তবে ওই সময় বেলপাহাড়ির নীল চাষিরা বিদ্রোহের পথে যাননি। কোনও প্রতিবাদের কথাও সে ভাবে শোনা যায় না।
এর কারণ কী? ঝাড়গ্রামের লোক সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ওই সময় বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলি ছিল রীতিমতো দুর্গম ও শ্বাপদসঙ্কুল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। অভাব ছিল বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী।’’ তাঁর কথায়, ‘‘জঙ্গল থেকে সহজেই মিলত হেঁশেলের জ্বালানি কাঠ। খাবারের জন্যও প্রকৃতিই ছিল ভরসা। সম্ভবত, সে জন্যই নীলকরদের চাপের মুখে নীলচাষ করেও বেলপাহাড়ির দরিদ্র বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় কোনও প্রভাব পড়েনি। কোনও বিদ্রোহও তাই দানা বাঁধেনি।” গবেষকদের দাবি, এলাকাবাসীর কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না থাকায় বেলপাহাড়ির নীলকুঠিতে কোনও কয়েদখানাও ছিল না।