Advertisement
E-Paper

নীলকুঠির ধ্বংসস্তূপে হারাচ্ছে ইতিহাস

সময়টা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তত্‌কালীন অবিভক্ত বাংলায় মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চল, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পাবনা ও খুলনায় একের পর এক নীলকুঠি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি আগুনে পুড়ছে।

কিং‌শুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০১:০৫
অনাদরে পড়ে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

অনাদরে পড়ে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

সময়টা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তত্‌কালীন অবিভক্ত বাংলায় মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চল, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পাবনা ও খুলনায় একের পর এক নীলকুঠি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি আগুনে পুড়ছে। অথচ সেই বিদ্রোহের কোনও আঁচ লাগেনি পশ্চিম সীমান্তে বাংলার পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা বেলপাহাড়ির শান্ত জনপদের গায়ে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা তখন দুর্ভেদ্য। স্থানীয় বাসা পাড়ায় নীলকুঠিতে রীতিমতো নীল তৈরির ভাটিখানা চলত। বেলপাহাড়ির বাসা পাড়ায় অতীতের সাক্ষী সেই নীলকুঠি এখন কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে নীল তৈরির চিমনি-সহ প্রস্তুতিকরণ ঘরটিও ভগ্নপ্রায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দেড়শো বছরের পুরনো নীলকুঠি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনিক স্তরে আজ পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ভূমি দফতরের পুরনো নথি থেকে জানা যায়, বেলপাহাড়ি, ভেলাইডিহা, সন্দাপাড়া, ভুলাভেদা, শিমুলপাল ও বাঁশপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে এক সময় নীল চাষ হত। তবে ওই সময় বেলপাহাড়ির নীল চাষিরা বিদ্রোহের পথে যাননি। কোনও প্রতিবাদের কথাও সে ভাবে শোনা যায় না।

এর কারণ কী? ঝাড়গ্রামের লোক সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ওই সময় বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলি ছিল রীতিমতো দুর্গম ও শ্বাপদসঙ্কুল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। অভাব ছিল বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী।’’ তাঁর কথায়, ‘‘জঙ্গল থেকে সহজেই মিলত হেঁশেলের জ্বালানি কাঠ। খাবারের জন্যও প্রকৃতিই ছিল ভরসা। সম্ভবত, সে জন্যই নীলকরদের চাপের মুখে নীলচাষ করেও বেলপাহাড়ির দরিদ্র বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় কোনও প্রভাব পড়েনি। কোনও বিদ্রোহও তাই দানা বাঁধেনি।” গবেষকদের দাবি, এলাকাবাসীর কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না থাকায় বেলপাহাড়ির নীলকুঠিতে কোনও কয়েদখানাও ছিল না।

মেদিনীপুরের ইতিহাস নিয়ে নিরন্তর চর্চা করে চলা প্রবীণ শিক্ষাব্রতী হরিপদ মণ্ডল ও প্রবীণ সাংবাদিক তারাপদ কর জানান, ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফর দ্বিতীয়বার বাংলার নবার হওয়ার পরে শিলদা পরগনার অন্তর্গত বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ অংশ চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি’-র অধীনে। বেলপাহাড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে কাছারি বাড়ি তৈরি হয়। পরে সেখানে ইংরেজ জমিদারের জন্য বাংলোও তৈরি হয়। বর্তমানে কাছারি বাড়িতে বেলপাহাড়ির বিডিও অফিস ও বাংলোটি বিডিও-র আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার আগেই অবশ্য বেলপাহাড়িতে নীল চাষ শুরু হয়। ইংরেজ জমিদারি কোম্পানির তরফে লেঠেল নিয়োগ করে গ্রামে গ্রামে চাষিদের দাদন দিয়ে নীলের চাষ করানো হতো। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বেলপাহাড়ি সদর এলাকাটিতে বাইরের লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়। জমিদারি কোম্পানির লেঠেল ও পাহারার কাজ করার জন্য বিহার থেকে লোক নিয়ে আসা হয়। বর্ধমান থেকে আসেন কোম্পানির কর্মচারীরা। সাহেবদের রসনা তৃপ্তির জন্য মেদিনীপুর থেকে আসেন বাবুর্চিরা। পরবর্তীকালে তাঁদের উত্তরসূরিরা বেলপাহাড়িতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় স্বাধীনতা আন্দোলন। জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের মধ্যে কংগ্রেসের উদ্যোগে স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে কংগ্রেসের দলীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বেলপাহাড়িতে জমিদারি কোম্পানির একটি কাছারিতে ভাঙচুর চালান আদিবাসীরা। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও কয়েক বছর বেলপাহাড়িতে ইংরেজ জমিদাররা থেকে গিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপ হলে বেলপাহাড়িতে ইংরেজ জমিদারি শাসনের অবসান হয়।

জমিদারি কোম্পানির পূর্বতন কাছারি বাড়িটি এখন বেলপাহাড়ি ব্লক অফিস। সাহেব বাংলোটিতে বিডিও-র আবাসন। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে সংস্কার হওয়ায় দু’টি সরকারি ভবনই এখন একেবারে ঝাঁ-চকচকে! আর বেলপাহাড়ির এক প্রান্তে বাসা পাড়ায় আদিবাসী-মূলবাসীদের রক্তঘামে নীল তৈরির আঁতুড় ঘরটিই বিলুপ্তি ও বিস্মৃতির অপেক্ষায় দিন গুনছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই বদলে গিয়েছে বেলপাহাড়ি। এখন বেলপাহাড়ির খাসতালুকে ৮ টি পাড়ায় হাজার দশেক মানুষের বাস। জনবহুল বাজারের বুক চিরে চলে গিয়েছে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াগামী রাজ্য সড়ক। পিচ রাস্তার ধারে ব্লক অফিস, থানা, স্কুল, দোকান-বাজার মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ। পিচ রাস্তার ধারে সেই ইংরেজ জমিদারি কোম্পানির কাছারি বাড়ি ও সাহেব বাংলোটির ভোল বদল হয়েছে। কাছারি বাড়িটি এখন বেলপাহাড়ি ব্লক অফিস। বাংলোটি বিডিও-র আবাসন। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে সংস্কার হওয়ায় দু’টি সরকারি ভবনই এখন একেবারে ঝাঁ-চকচকে!

অন্য দিকে, বাসা পাড়ায় নীলকুঠির ধ্বংসস্তূপ লাগোয়া চত্বরে পুরনো কয়েকটি ঘরে সরকারি কর্মীদের কয়েকটি আবাসন হয়েছে। কিন্তু ঝোপঝাড়ে ভর্তি নীলকুঠিটি পড়ে রয়েছে অনাদরে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নীলকুঠির ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত নন।

বেলপাহাড়ির প্রবীণ বাসিন্দা শঙ্কর দুবে, চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বন্দিরাম দেশোয়ালি-দের বক্তব্য, নীলকুঠিটির বেশির ভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখনও যেটুকু রয়েছে অবিলম্বে তা সংস্কার করা না-হলে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি ধুলোয় মিশে যাবে।”

এলাকাবাসীর অভিযোগ, জঙ্গলমহলের উন্নয়নের এত প্রতিশ্রুতির মধ্যেও নীলকুঠি নিয়ে প্রশাসন উদাসীন।

বেলপাহাড়ির বিডিও সর্বোদয় সাহা বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। নীলকুঠি সংস্কারের জন্য উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে।”

belpahari neelkuthi vulaveda neelkuthi indigo farmers medinipur indigo farmers indigo trader british kingshuk gupta neelkuthi debri indigo traders history
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy