কেশপুরে বিভিন্ন এলাকায় উড়ছে শুধু তৃণমূলের পতাকা। নিজস্ব চিত্র
কেশপুরে ঢোকার আগে চোখ যাবে এক সংস্থার বিজ্ঞাপনী প্রচার- হোর্ডিংয়ে। দেবের ছবির পাশে যেখানে লেখা, ‘ডায়লগে নয়, ভরসায় টপ’।
বাস্তবেই তাই। ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কেশপুর বরাবরই শাসককে ভরসা জুগিয়েছে। ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটে এই কেশপুর থেকেই রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লিড পেয়েছিল সিপিএম। ১ লক্ষ ৮ হাজার! তৎকালীন বিরোধী তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছিল, অবাধ ভোটে কি এত লিড সম্ভব? সেই কেশপুর থেকে ২০১৪ লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী দেবের লিড ছিল প্রায় ১ লক্ষ ১৭ হাজার! গত বিধানসভা ভোটে একটু কমে জয়ের ব্যবধান হয় প্রায় ১ লক্ষ ১ হাজার। তাই কেশপুর নিয়ে আত্মবিশ্বাসী শাসক দল। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি সেদিন দলের কর্মীদের বলছিলেন, ‘‘গতবারে কেশপুর যে ভোট দিয়েছিল আমাদের, এ বার তার চেয়ে বেশি কিছু ভোট দিতে হবে। এটাই আমাদের আবেদন, অনুরোধ।’’ আর প্রকাশ্য সভায় অজিতের ঘোষণা, ‘‘গতবার দেবের লিড ২ লক্ষ ৬০ ছিল। এ বার ৩ লক্ষের উপরে চলে যাবে। একদম নিশ্চিত থাকুন!’’ বিরোধীরা বলেছে, কেশপুরে গণতন্ত্রের পরিবেশ নেই।
মাস ঘুরলেই ভোট। কিন্তু কেশপুর নিরুত্তাপ। কেশপুর থেকে আনন্দপুর- সাত কিলোমিটার এই রাস্তার কোথাও বিরোধী প্রার্থীর দেওয়াল লিখন নেই। পতাকা, পোস্টার, ফেস্টুন নেই। দু’দিকেই শুধু তৃণমূলের পতাকা আর দেওয়াল লিখন। শুধু এই রাস্তা কেন, কেশপুরের সব রাস্তার ছবিটাই এক।
জামশেদ আলি ভবন। কেশপুর সিপিএমের জোনাল কার্যালয়। বাম আমলে এখান থেকেই পরিচালিত হত কেশপুরের ‘সব কিছু’। মাঝে দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। ভোটের মুখে ফের খুলেছে সেই কার্যালয়। তবে প্রায় সুনসান থাকে। সেদিন জামশেদ ভবনে গিয়ে দেখা আহমেদ আলির সঙ্গে। দলের জোনাল সম্পাদক আহমেদ। পতাকা, পোস্টার তো শুধু এই পার্টি অফিসেই? আহমেদ বলছিলেন, ‘‘কেশপুরে এখন গণতন্ত্রই বিপন্ন। পতাকা, পোস্টার লাগিয়ে কি হবে? রাতের অন্ধকারে তৃণমূলের লোকেরা ছিঁড়ে দেবে!’’ বিজেপির একটিও কার্যালয় নেই। বিজেপির রাজ্য সম্পাদক তুষার মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অবাধ ভোটের পরিবেশই নেই।’’
মোঘলযুগের আফগানশাসক শেরশাহের ভূমিরাজস্ব আদায়ের জন্য তৈরি হওয়া ভঞ্জভূম ও ব্রাক্ষ্মণভূম পরগনার যুক্ত অংশই হল আজকের কেশপুর। তমাল নদী এই দুই পরগনার সীমানা নির্ধারণ করেছে। একদিকে লাল পাথুরে মাটিতে শাল, শিমূল, মহুয়ার চিরসবুজ বনানী। অন্যদিকে তমাল, পারাং, কুবাইয়ের আশেপাশে শস্যশ্যামলা সমভূমি। একদা লালদুর্গ এখন সবুজগড়। আগে সিপিএমের বিরুদ্ধে ভোট লুঠের অভিযোগ উঠত। এখন সেই একই অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সবক’টি শাসক দলের দখলে। এখানে তরতর করে চড়ে ভোটদানের হার। এক- একটি বুথে ভোট শুরুর তিন- চার ঘন্টার মধ্যেই ৩০- ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে যায়। ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, এমন বুথের সংখ্যাও কম নয় এখানে। কেশপুরে বিরোধী নেই? তৃণমূলের কেশপুর ব্লক সভাপতি সঞ্জয় পান বলছেন, ‘‘মানুষ যদি ওদের সঙ্গে না থাকে তো আমরা কি করব! পায়ের তলায় মাটি নেই।’’
কেশপুর বাজারে দেখা শেখ নাসিরুদ্দিন, শেখ আজহারদের সঙ্গে। নাসিরুদ্দিন বলছিলেন, ‘‘লুঠপাট, মারপিট আর ভাল লাগে না। এলাকায় শান্তি থাকলেই হল।’’ আজহারের কথায়, ‘‘কত যে বোমা পড়েছে এই তল্লাটের গাঁ- ঘর- উঠোনে, তার ইয়ত্তা নেই। এখন গোলমাল নেই। কিন্তু কখন গোলমাল বাধবে কেউ জানে না।’’ সেদিন তৃণমূলের তেঘরির প্রচারসভায় এসেছিলেন পলাশ মহাপাত্র। বিঘা ছয়েক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন পলাশ। অতিবৃষ্টিতে সে চাষ নষ্ট হয়েছে। দেব মঞ্চ ছাড়ার পরে পলাশ বলছিলেন, ‘‘জমির আলু ঘরে তুলতে পারিনি। বৃষ্টিতে সব চাষ শেষ হয়ে গিয়েছে।’’ ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছেন? তেঘরির এই চাষি বলছিলেন, ‘‘আবেদন করেছি। শুনেছি, ভোটের পরেই ক্ষতিপূরণের টাকাটা না কি পেয়ে যাব। পেলে কিছুটা সুরাহা হবে, এই আর কী!’’ কর্মিসভায় দেবকে বলতেও শোনা গিয়েছে, ‘‘দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আগামী দিনেও আপনাদের পাশে থাকব। ১২ মে নিজের ভোটটা নিজে দেবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy