কোচিং ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
আর মাত্র দু’বছর। ২০১৮ সালে সাঁওতালি ভাষা আর অলচিকি লিিপতে প্রথম মাধ্যমিক দেবে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু সরকারিস্তরের উদ্যোগ যেন সিন্ধুতে বিন্দু। সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল আছে, কিন্তু েনই পর্যাপ্ত শিক্ষক। পরিকাঠামোগত নানা সমস্যাও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের ভরসায় না-থেকে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় সাঁওতালি মাধ্যমের পড়ুয়াদের জন্য ঝাড়গ্রামে বিশেষ কোচিং ক্যাম্প চালু করা হয়েছে বিনামূল্য।
পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও মুর্শিদাবাদের ২৭টি স্কুলের ২২০ জন ছাত্রছাত্রী এ বার নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই পড়ুয়ারাই ২০১৮ সালে রাজ্যে প্রথমবার সাঁওতালি মাধ্যমে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বিজ্ঞান বা সাহিত্য— সবই এদের পড়তে হয় সাঁওতালি ভাষায় ও অলচিকি লিপিতে। কিন্তু সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলে রয়েছেন হাতে গোনা পার্শ্বশিক্ষক। পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ান তাঁরা। ফলে, নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের মাধ্যমিক প্রস্তুতির জন্য স্কুলগুলির পক্ষে বাড়তি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে জন্য ছ’টি আদিবাসী সংগঠনের সমন্বয় কমিটি উদ্যোগী হয়ে গরমের ছুটিতে বিশেষ কোচিং-এর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ঝাড়গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুল তাদের ক্লাসঘর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ওই স্কুলের হস্টেলেই ঠাঁই হয়েছে কোচিং নিতে আসা ছাত্রছাত্রীদের। পড়ুয়াদের থাকা ও খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছেন উদ্যোক্তারা।
গত ২৫ মে থেকে বিশেষ কোচিং ক্যাম্পটি শুরু হয়েছে। চলবে ৮ জুন পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২ টা এবং দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস চলছে। রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ২০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা স্বেচ্ছায় পড়ানোর জন্য এসেছেন এখানে। হুগলির হরিপাল হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক বকুল মুর্মু, ডানকুনির একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা সুমিত্রা হাঁসদা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষক-শিক্ষিকা হলেও তাঁরা অলচিকি লিপিতে সড়গড়। শিবিরে মাতৃভাষায় প্রাঞ্জল ভাবে পড়াচ্ছেন তাঁরা। আবার জামবনির বাহিরগ্রাম স্কুলের মণ্ডল সরেনের মতো সাঁওতালি মাধ্যমের শিক্ষকরাও শিবিরে স্বেচ্ছায় পড়াতে এসেছেন। খুশি পড়ুয়ারাও। ঝাড়গ্রামের নবম শ্রেণির শালকু মাণ্ডি, সুনীল হেমব্রম, বাঁকুড়ার লখিন্দ্র টুডু, মুর্শিদাবাদের লীলাবতী হেমব্রম-রা জানায়, “ভাল ফলের জন্য কী ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেটা শিখছি।”
শিবিরের পরিচালক ও উপদেষ্টা মণ্ডলীতে রয়েছেন কেন্দ্রীয় নির্মাণ সংস্থার প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার কুনার হেমব্রম, শিক্ষাব্রতী হেমন্ত হেমব্রম, লুদা সরেন, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্মী গোবিন্দ মাণ্ডির মতো বিশিষ্টজনরা। কুনার হেমব্রম বলেন, “সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলগুলিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নেই। সময়মতো পড়ুয়ারা সরকারি পাঠ্যবই পায় না। নবম শ্রেণি থেকে পড়ুয়াদের বিশেষ ভাবে দেখভালের প্রয়োজন। সে জন্য আমরা যতটা সম্ভব আন্তরিক ভাবে এই ব্যবস্থা করছি।” শুধু গরমের ছুটিই নয়, আগামী পুজোর ছুটিতেও পড়ুয়াদের বিনা খরচে বিশেষ কোচিং দেওয়া হবে বলে তিনি জানালেন। ২০১৭ সালের দুই ছুটিতেও একই ধরনের কোচিং দেওয়া হবে।
এখনও রাজ্যে সাঁওতালি ভাষায় ও অলচিকি লিপিতে পঠনপাঠনের সামগ্রিক ছবিটা আশানুরূপ নয়। ২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এরপর বাম জমানায় হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলে প্রাথমিকস্তরে পঠনপাঠন শুরু হয়। আদিবাসী সংগঠনগুলির নিরন্তর দাবিতে ২০১১ সালে এ রাজ্যে সাঁওতালিকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সাঁওতালি মাধ্যমে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে এখনও উপযুক্ত পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি।
ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের কেন্দুগাড়ি অঞ্চলের ধানশোল আদিবাসী হাইস্কুলে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ৭০ জন পড়ুয়া। মাত্র দু’জন অলচিকি পার্শ্বশিক্ষক। এই পরিস্থিতিতে আদিবাসী সংগঠনের তরফে তিন জন অবৈতনিক শিক্ষক সেবামূলক শিক্ষাদান করছেন। তা সত্ত্বেও বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকের অভাবে পড়ুয়াদের সমস্যা হচ্ছে। একই পরিস্থিতি বাঁকুড়ার শালতোড়া ব্লকের চাঁদড়া কল্যাণসঙ্ঘ হরিজন হাইস্কুলেও। বিষয় ভিত্তিক পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ভাষার শিক্ষক ধরমদাস টুডুকে বিজ্ঞানের ক্লাসও নিতে হয়।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সামাজিক কর্মকর্তা (দিশম পারগানা) নিত্যানন্দ হেমব্রম বলেন, “আদিবাসী সমাজের এমন বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy