লালগড়ের রাজবাড়ির রথ।
লালগড় রাজবাড়ির তিনশো বছরের পুরনো ঐতিহ্যের রথের নায়ক হলেন রাধামোহন জিউ। রাজ পরিবারের ‘কুলদেবতা’ কষ্টিপাথরের এই ত্রিভঙ্গ কৃষ্ণ বিগ্রহের বাম পাশে থাকেন অষ্টধাতুর শ্রীমতী। রাধামোহন ও শ্রীমতীর সঙ্গে রথযাত্রায় সঙ্গী হন রাজ পরিবারের প্রাচীন মন্দিরের আরও কয়েকটি বিগ্রহ। অতীতের সেই জৌলুস আজ আর নেই। তবে প্রতি বছর এখনও পঞ্জিকার নির্ঘণ্ট মেনে অমৃতযোগে রাধামোহনের রথযাত্রার সূচনা হয়। শনিবার সন্ধ্যায় কয়েক হাজার মানুষের জনসমাগমে স্থানীয় রথতলা থেকে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে সপার্ষদ রাধামোহনের রথের যাত্রা শুরু হয়। রাতে হাটচালায় মাসির বাড়িতে পৌঁছে যাত্রা শেষ হল।
লালগড়ের স্থানীয় লোক-সংস্কৃতি গবেষক পঙ্কজকুমার মণ্ডল বলেন, “লালগড়ের রথযাত্রা উত্সবটি আদতে রাজ পরিবারের উদ্যোগে শুরু হলেও এটি কিন্তু এলাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সর্বজনীন উত্সব। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ স্বর্ণসাজে সজ্জিত রাধামোহন জিউকে একটি বার চোখের দেখা দেখতে আসেন।”
সে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। লালগড়ের রাজা তখন রসিকনারায়ণ সাহসরায়। এক সন্ন্যাসী এলেন রাজদর্শনে। সন্ন্যাসীর সঙ্গে একটি কষ্টি পাথরের কৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। নাম তার ‘রাধামোহন জিউ’। জনশ্রুতি, সন্ন্যাসী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কৃষ্ণের বিগ্রহটি রসিকনারায়ণকে দান করে যান। সেই থেকে লালগড়ে রাজ পরিবারের সেবায় রাধামোহন জিউ ও শ্রীমতীর নিত্যপুজো চলেছে। লালগড়বাসীর জীবনচর্যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন রাধামোহন। শোনা যায়, শুরুতে একাই ছিলেন রাধামোহন। লালগড় রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য দর্পনারায়ণ সাহসরায় বলেন, “লালগড় রাজবাড়ির অদূরে বাবুপাড়ায় মন্দিরে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাধামোহন স্বপ্নাদেশে রাজাকে বলেছিলেন, ‘এ বার আমার শ্রীমতী চাই। শ্রীমতীর সঙ্গেই রথে চড়ব’। রাধামোহনের স্বপ্নাদেশে লালগড়ের অদূরে বালি-দুমদুমির জঙ্গলের এক জায়গায় শ্রীমতীর সন্ধানে মাটি খোঁড়া শুরু হয়। দর্পনারায়ণ বলে চলেন, “রসিকনারায়ণকে স্বপ্নাদেশে রাধামোহন জিউ জানিয়েছিলেন, আড়াই কোদাল মাটি খঁুড়লেই শ্রীমতীকে পাওয়া যাবে। কিন্তু রাজার লোক-লস্করেরা ভুল করে তিন কোদাল মাটি তুলে ফেলায় কোদালের আঘাত লাগে শ্রীমতীর কপালে। সেই থেকে আমাদের অষ্টধাতুর শ্রীমতীর কপালে কাটা দাগ রয়েছে।” দর্পনারায়ণ জানান, আগে ১৮ চাকা বিশিষ্ট দোতলা বিশাল কাঠের রথ ছিল। সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২৫ বছর আগে আট চাকার লোহার রথ তৈরি করানো হয়। গত আড়াই দশক ধরে সপার্ষদ রাধামোহন ও শ্রীমতী সেই লোহার রথেই চড়েন।
রাধামোহন জিউয়ের বিগ্রহ।
রথযাত্রার বিকেলে মন্দির থেকে রাধামোহন ও শ্রীমতীর বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় রথ তলায়। কেবলমাত্র এ দিনই রাধামোহন ও শ্রীমতীকে সোনার অলঙ্কারে সাজানো হয়। রাধামোহন-শ্রীমতীর সঙ্গে আরও দু’টি কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ বিগ্রহ গোপীনাথ জিউ ও গোবিন্দ জিউ এবং তাঁদের দু’জন শ্রীমতী রথে সওয়ার হন। সেইসঙ্গে রাজ মন্দিরের অষ্টধাতুর ধাম গৌরাঙ্গ, চারটি গোপাল, কৃষ্ণ ও বলরাম এবং নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথও রথে ওঠেন। রথযাত্রার সন্ধ্যায় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে, অমৃতযোগে রথের রশি টানা শুরু হয়। স্থানীয় হাটচালায় মাসির বাড়িতে পৌঁছে যাত্রা শেষ হয়। এই ক’টা দিন মাসির বাড়িতেই সপার্ষদ রাধামোহন-শ্রীমতীর নিত্যপুজো হবে। এবারও সেখানে ৯দিনের মেলা বসেছে। রয়েছে বিবিধ মনোরঞ্জনের আয়োজন। উল্টোরথে সপার্ষদ রাধামোহন ও শ্রীমতীকে ফিরিয়ে আনা হবে বাবু পাড়ার মন্দিরে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
লালগড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কৃষ্ণগোপাল রায় বলেন, “এক সময় জাঁকজমকে লালগড়ের রথ সবাইকে টেক্কা দিত। আগের মতো না হলেও গত কয়েক বছরে আমরা কিছুটা জৌলুস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy