Advertisement
E-Paper

‘পান্থসখা’য় সাহিত্যের আড্ডায় আজ ভাটা

মাটির উনুনে চাপানো মস্ত কড়াই। ভাজা হচ্ছে চপের পুর। আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কার ঝাঁঝের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আড্ডার ঝাঁঝও। ইটের গাঁথনি আর অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া প্রশস্ত ঘরটিতে মলিন টেবিল ঘিরে পাতা রয়েছে বেঞ্চ-চেয়ার। সেখানেই চলছে ঠাসাঠাসি আড্ডা, আলোচনা। তরুণ কবিরা তাঁদের শব্দবন্ধের ঠিক-ভুলের যাচাই করে নিচ্ছেন কবিতা শুনিয়ে। সদ্যোজাত কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি, আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে ইংরেজি, গ্রিক ও ফরাসি সাহিত্যের প্রসঙ্গও।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৪
আড্ডার মেজাজ এখন অনেকটাই ফ্যাকাশে। (ইনসেটে) অশোক মোহান্তির ছবি ও দেওয়াল পত্রিকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

আড্ডার মেজাজ এখন অনেকটাই ফ্যাকাশে। (ইনসেটে) অশোক মোহান্তির ছবি ও দেওয়াল পত্রিকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

মাটির উনুনে চাপানো মস্ত কড়াই। ভাজা হচ্ছে চপের পুর। আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কার ঝাঁঝের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আড্ডার ঝাঁঝও।

ইটের গাঁথনি আর অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া প্রশস্ত ঘরটিতে মলিন টেবিল ঘিরে পাতা রয়েছে বেঞ্চ-চেয়ার। সেখানেই চলছে ঠাসাঠাসি আড্ডা, আলোচনা।

তরুণ কবিরা তাঁদের শব্দবন্ধের ঠিক-ভুলের যাচাই করে নিচ্ছেন কবিতা শুনিয়ে। সদ্যোজাত কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি, আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে ইংরেজি, গ্রিক ও ফরাসি সাহিত্যের প্রসঙ্গও। আড্ডা পর্বে চায়ের সঙ্গে গরম চপ-সিঙাড়া উঠে আসছে হাতে হাতে। উল্টোদিকের টেবিলে বসে পরোটা-তরকারি-মিষ্টির খদ্দেররাও কান খাড়া করে শ্রোতার ভূমিকায়।

এক দশক আগেও ঝাড়গ্রামের ‘পান্থসখা হোটেল’-এ এমনটাই ছিল নিত্য দিনের চেনা ছবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যশহরের ‘কফি হাউস’ হিসেবে পরিচিত পান্থসখার সেই আড্ডাটাও আজ আর আগের মতো নেই। এখন প্রতিদিন মেরে কেটে ৭-৮ জন আসেন। এক সময় এই আড্ডার মধ্যমণি কবি অশোক মোহান্তি আর জীবিত নেই। আশির দশকে অশোকবাবুর হাত ধরেই অরণ্যশহরের কোর্ট রোডের ধারে পান্থসখা হোটেলটি চালু হয়েছিল। ন’টি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা অশোকবাবু প্রয়াত হয়েছেন প্রায় এক যুগ হতে চলল। কিন্তু পান্থসখায় প্রয়াত কবির ‘সাহিত্যের আড্ডা’টি আজও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর অনুরাগীরা।

এই আড্ডার সদস্য কবি সংযম পালের মতো কয়েকজন পরবর্তী কালে কলকাতায় পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আড্ডার অন্যন্য কবি বন্ধুরাও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে চলেছেন। কারও কারও একাধিক কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। অনেকে আবার হারিয়েও গিয়েছেন। তবে এ শুধু সাহিত্যচর্চা কিংবা কবিতার বই ও পত্রিকা প্রকাশের মধ্যেই আটকে থাকা নয়। সামাজিক অবক্ষয়, কুসংস্কার ও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধেও নানা সময়ে পথে নেমেছেন এই সাহিত্য বাসরের সদস্যরা। এখানেই আড্ডা দিয়েছেন সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত-র মতো বহু বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিকরাও। সে সবই অবশ্য আজ ইতিহাস।

এখন হোটেলটি চালাচ্ছেন অশোকবাবুর সেজ ভাই উত্তম মোহান্তি। তিনি লেখক না হলেও সাহিত্যের গুণগ্রাহী। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে উত্তমবাবু জানালেন, কিশোর বয়স থেকেই কবিতায় দিনযাপন শুরু হয়েছিল তাঁর দাদার। সত্তরের দশকে অশোকবাবু তখন সদ্য যুবা। ঝাড়গ্রাম শহরের স্টেশন রোডে একটি খাবার দোকানে ম্যানেজারের কাজ করতেন তিনি। সঙ্গে চলত অবিরাম লেখালিখি আর সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা। ওই সময় কোর্টের লাগোয়া একটি আমগাছের তলায় রীতিমতো সাহিত্য আলোচনা জমে উঠত।

সত্তর ও আশির দশকে সেই আড্ডার সূত্রেই অশোক মহান্তী সম্পাদিত ‘সাম্প্রতিক’ (পরবর্তীকালে ‘সাম্প্রতিক কাল’), রাজ কলেজের বাংলার অধ্যাপক জগৎ লাহার সম্পাদনায় ‘পূর্ণিমা বাসর’, কবি দিলীপ দাসের সম্পাদনায় ‘দ্রৌপদী’, অমৃত নন্দীর সম্পাদনায় ‘সমক্ষ’, তৃপ্তেন্দু হোতার ‘শালপাতা’, হিমাংশু বাগচির ‘দুন্দুভি’, সংযম পালের ‘শ্রাবন্তী’ ও মনোজিৎ সেনগুপ্তর ‘এখানে’-র মতো সাহিত্য পত্রিকা গুলির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। পরে অবশ্য সব ক’টিই বন্ধ হয়ে যায়। ঝাড়গ্রাম আদালতের সাহিত্যপ্রেমী কয়েকজন বিচারকও অশোকবাবুর আড্ডায় নিয়মিত হাজির হতেন। তাঁদেরই অন্যতম ছিলেন ঝাড়গ্রামের দেওয়ানি বিচারক শৈলেন্দ্রপ্রসাদ তালুকদার। আশির দশকের গোড়ায় শৈলেন্দ্রপ্রসাদবাবুর সুপারিশক্রমে বিচার বিভাগীয় দফতর থেকে অরণ্যশহরের কোর্ট রোডের ধারে লিজে খানিকটা জমি পান অশোকবাবু।

১৯৮০ সালের ১৪ এপ্রিল সেখানেই ‘পান্থসখা’র পথচলা শুরু। প্রথমে ছিল ছিটেবেড়ার ঘর। পরে ইটের গাঁথনির উপর অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সাল নাগাদ সাহিত্যের আড্ডাটি আমতলা থেকে উঠে আসে অশোকবাবুর নিজস্ব হোটেলে। কবি স্বপন মল্লিক, সুকমল বসু, দিলীপ দাসের কথায়, “ওই সময় দুপুরবেলা পান্থসখায় খদ্দেরের ভিড় থাকলে কোর্ট চত্বরে আইনজীবীদের খড়ের চালায় গিয়ে আমরা আড্ডা দিতাম। আবার সন্ধে থেকে রাত পর্যত আড্ডা চলত হোটেলের টেবিলে। পরে ১৯৯৬ সালে আড্ডার বন্ধু বংশীমোহন প্রতিহারের উদ্যোগে ‘সাহিত্যের আড্ডা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই প্রকাশনা আজও চলছে।”

পেশায় ঝাড়গ্রাম ব্লক অফিসের কর্মী বংশীবাবু সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী। তাঁর কথায়, “এই আড্ডাই হল জঙ্গলমহলের সাহিত্যচর্চার আঁতুড় ঘর। শতাধিক কবি ও লেখক এই আড্ডার বন্ধু। সময়ের অভাবে এখন অবশ্য অনেকেই বাজির হতে পারেন না আড্ডায়।” প্রতি বছর ২৪ অগস্ট অশোকবাবুর মৃত্যুদিবসে সকলেই চেষ্টা করেন স্মৃতি তর্পণের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।

প্রবীণদের পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের কবিরাই এখন আড্ডার ভবিষ্যৎ। জগদীশরা অবশ্য বলছেন, “চিরকাল কোনও কিছুই এক রকম থাকে না। আশায় আছি আড্ডার সুদিন হয়তো ফিরে আসবে।”

ashok mohanty pantho sokha amar shohor amar sohor jhargram kingshuk gupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy