Advertisement
০৯ মে ২০২৪

পাপা, ইয়ে লোগ হমকো মার ডালেঙ্গে

ব্যবসার কাজেই বাইক নিয়ে ছেলেটা বেরিয়েছিল। বন্ধু দেবব্রত সেনকে মাঝ রাস্তায় নামিয়েও দিয়েছিলেন। বছর ছাব্বিশের রকি জানিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একসঙ্গে খিচুড়ি-ভোগ খেতে যাবেন। ফেরা হয়নি রকির। ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল।

নিহত সৌরভ ওরফে রকি (বাঁ দিকে)। দোষীদের শাস্তির দাবিতে পথে ঝাড়গ্রাম। ফাইল চিত্র।

নিহত সৌরভ ওরফে রকি (বাঁ দিকে)। দোষীদের শাস্তির দাবিতে পথে ঝাড়গ্রাম। ফাইল চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১১
Share: Save:

ব্যবসার কাজেই বাইক নিয়ে ছেলেটা বেরিয়েছিল। বন্ধু দেবব্রত সেনকে মাঝ রাস্তায় নামিয়েও দিয়েছিলেন। বছর ছাব্বিশের রকি জানিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একসঙ্গে খিচুড়ি-ভোগ খেতে যাবেন। ফেরা হয়নি রকির।

২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল।

ঝাড়গ্রাম শহরের বলরামডিহির বাসিন্দা অরণ্যশহরের ব্যবসায়ী পবনকুমার অগ্রবালের একমাত্র সন্তান নির্মাণ সরঞ্জামের তরুণ ব্যবসায়ী রকির মোটরবাইকটি সেদিনই নম্বর প্লেট খোলা অবস্থায় মিলেছিল ঝাড়গ্রামের সাপধরা এলাকায়। ঝাড়গ্রাম থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন পবনবাবু। রকিকে খঁুজে বের করার জন্য পুলিশের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়।

সপ্তাহ গড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে অপহরণকারীরা রকির পরিজনদের ফোন করে মুক্তিপণ বাবদ তিন কোটি টাকা দাবি করে। রকির চোখ বাঁধা অবস্থায় মাথায় পিস্তল ঠেকানো একটি মোবাইল ভিডিও ফুটেজও আসে পুলিশের হাতে। তাতে রকির কাতর আবেদন, ‘পাপা ঘরকে সামনে সে পুলিশ হটা দিজিয়ে। বঁচা লিজিয়ে। ইয়ে লোগ হমকো মার ডালেঙ্গে।’

রকি অপহৃত হওয়ার পর পবনবাবুর ব্যবসায়িক বন্ধু রেলের ঠিকাদার অশোক শর্মা নিয়ম করে পবনবাবুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতেন, সান্ত্বনা দিতেন। চা খেয়ে ফিরতেন। কিন্তু মোবাইল ফোনের কথোপকথনের সূত্র ধরে অশোকই অপহরণের মূল চক্রী বলে ঠাওর করে পুলিশ। কিন্তু কোনও ভাবে সে খবর পৌঁছে যায় অপহরণকারীদের কাছে। ২০১৪ সালের ৬ মে ওড়িশার গঞ্জামের রম্ভা এলাকায় রকির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, পবনবাবুর পারিবারিক বন্ধু পেশায় রেলের ঠিকাদার অশোক শর্মাই এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের নাটের গুরু। রকিকে অপহরণ করে খুনের অভিযোগে ২০১৪ সালের মে মাসে অশোক ও তাঁর ভাইপো সুমিত শর্মা, অশোকের পরিচারক টোটন রাণা ও এক আত্মীয় দীনেশ শর্মা-সহ ছ’জন গ্রেফতার হন। মাস খানেক পরে অশোকের স্ত্রী পুনম শর্মাকে বেঙ্গালুরুর গোবিন্দপুরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ।

ঝা়ড়গ্রাম প্রথম দায়রা আদালতের সরকারি কৌসুলি প্রশান্ত রায় জানান, পুলিশ দুই অভিযুক্তকে বাদ দিয়ে অশোক, পুনম-সহ পাঁচ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ধৃত পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ঝাড়গ্রাম প্রথম দায়রা আদালতে চার্জগঠন হয়। গত বছরের গোড়ায় বিচারও শুরু হয়। কিন্তু নানা ভাবে বিচার প্রক্রিয়া মন্থর করার অভিযোগ ওঠে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। মামলাটি অন্য আদালতে সরানোর জন্য অভিযুক্তরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। সেই আবেদন হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ায় বছর খানেক হতে চলল ঝাড়গ্রাম দায়রা আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। ইতিমধ্যে অশোকের স্ত্রী অন্যতম অভিযুক্ত পুনম শর্মা হাইকোর্টের নির্দেশে শর্তাধীন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। অশোক শর্মা-সহ চার অভিযুক্ত জেলবন্দি রয়েছেন।

কেন ‘আঙ্কেল’ অশোক খুন করলেন রকিকে? ছাব্বিশ বছরের রকিকে নির্মম-নিষ্ঠুর ভাবে খুনের কারণ কি শুধুই ব্যবসায়িক রেষারেষি, নাকি অন্য কিছু!

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রকি হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্তে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত নেই। পুলিশের তদন্তে দাবি করা হয়েছে, অশোক ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা টাকার জন্য রকিকে অপহরণ করেছিল। ধরা পড়ার ভয়ে রকিকে খুন করা হয়। রকির ঘনিষ্ঠজনদের একাংশ অবশ্য মনে করেন, টাকার পাশাপাশি, আরও কিছু কারণ ছিল, যা প্রকাশ্যে আসেনি।

ঘটনার পরে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রকি’ গ্রুপে আছড়ে পড়েছিল প্রতিবাদ-ধিক্কার। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল ঝাড়গ্রাম। ১৮ মাস পরে সেই আবেগ এখন অনেকটাই স্তিমিত। পবনবাবু ও তাঁর স্ত্রী সত্যভামাদেবী রকির স্মৃতিতে ট্রাস্ট গড়ে নানা ধরনের সমাজসেবা মূলক কাজকর্ম করছেন। রকির বন্ধু উত্তরপাড়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দেবব্রত সেন বলেন, ‘‘ওর সঙ্গে গেলে এমন হত না। এই আফশোস সারা জীবনেও যাবে না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

special story muder crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE