রাঙাডিহায় ক্লাব ঘরের সামনে মহিলা ফুটবল দল। —নিজস্ব চিত্র।
দু’বেলা পেট ভরে খাবার জোটে না, তবু নিয়ম করে মাঠে ঘাম ঝরান ওরা। শুধু ফুটবলের জন্য। একটা সময় এই খেলা নিয়ে অনেক বাঁকা কথাও শুনতে হয়েছে নিয়ম করে। তবু হার মানতে নারাজ ওরা।
না, কোনও ‘সাহেব’ নন। বরং এঁদের ‘কণি’-র সঙ্গে তুলনা করলেই ভাল মানায়। সংসার চালাতে কেউ কাজ করেন একশো দিনের প্রকল্পে, কেউ আবার দিন মজুরিও করেন। সঙ্গে অনেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন পড়াশোনাটাও। সাঁকরাইলের মহিলা ফুটবল দল এ ভাবেই এগিয়ে চলেছে নিজেদের লক্ষ্যে।
তবে সহায়তায় রয়েছেন প্রশাসনের অনেকেই। বছর দুয়েক আগে যে ভাবে তাদের সাহায্য করেছিলেন বিডিও এবং অন্যান্যরা, এখনও সে ভাবেই করে চলেছেন। খেলার মানের উন্নতি ঘটাতে এবার সাঁকরাইলের মহিলা ফুটবল খেলোয়াড়দের বড় ম্যাচ দেখানোর ব্যবস্থা করলেন তাঁরাই প্রশাসন।
আজ অর্থাৎ শনিবার ওই মহিলা খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। এদিন সেখানে মোহনবাগানের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল ম্যাচ রয়েছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মোহনবাগান ক্লাবও। তাই শুধু খেলা দেখা নয়, কলকাতার বড় দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও রয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজনায় ফুটছেন সুস্মিতা টুডু, শিউলি হাঁসদারা। তাঁদের কথায়, “ভাবলেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। প্রশাসন সাহায্য না করলে এত বড় সুযোগ কোনদিন আসত না। বড় ম্যাচে খেলার ধরন দেখে নিজেদের খেলারও মানের উন্নতি ঘটবে বলেই আশা করছি।”
বছর দু’য়েক আগে সাঁকরাইল ব্লকের রাঙাডিহার ফুটবল মাঠে মেয়েদের অনুশীলন বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের মনে দাগ কেটেছিল। সে দিন তাঁর সঙ্গে তাল মেলান প্রধানমন্ত্রী রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফেলো অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মহিলা ফুটবল দলকে জাতীয় স্তরে তুলে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। সাহায্য মিলেছিল তৎকালীন জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারিরও। তারই জেরে ওই দলটি চলতি বছরে রাজ্য স্তরে ভাল ফল করে। সুব্রত কাপেও খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
এ বার তাঁদের খেলার মান উন্নয়নে এবার বড় ম্যাচ দেখানোর ব্যবস্থা করল প্রশাসন। বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বড় ম্যাচ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তাছাড়াও অন্য ধরনের উৎসাহ মিলবে। তাই এই ধরনের পরিকল্পনা।” কোচ অশোক সিংহের কথায়, “এটা যে কত বড় প্রাপ্তি তা বলে বোঝানো যাবে না। মেয়েরা তো সারাক্ষণ এ নিয়েই মেতে রয়েছে। এই উৎসাহ নিশ্চয় ওদের খেলার জীবনেও পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে আশা করব।”
শুধু খেলা দেখানোই নয়, সকাল থেকেঅ রয়েছে আরও নানা পরিকল্পনা। শনিবার কলকাতাতে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষারও ব্যবস্থা করা হবে। এ ব্যাপারে একটি বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি দু’টি সংস্থার সঙ্গেও কথা হয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের শরীর সুঠাম রাখতে যা প্রয়োজনীয় তার ঘাটতি কোথায় রয়েছে দেখা হবে সে সব। তারই সঙ্গে খেলার মাঠে প্রতি মুহূর্তে নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে দৈনন্দিন জীবনে কী করা উচিত, কী উচিত নয়, সে বিষয়েও একটি ছোট্ট আলোচনার ব্যবস্থাও রয়েছে। থাকবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
তারপর খাওয়া-দাওয়া। বিকেলে সোজা খেলার মাঠে গিয়ে খেলা দেখা। খেলা শেষে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। সঙ্গে দু’একটা টিপসও শিখে নেওয়া।
এর আগেও এই ফুটবল দলকে খেলার সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। মাঠে পানীয় জল, খেলার সরঞ্জাম রাখা, পোশাক পরিবর্তনের জন্য ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী তাঁদের সাহায্যের জন্য ইউনিসেফের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। ইউনিসেফ সাঁকরাইলের পাশাপাশি নয়াগ্রামেরও একটি মেয়েদের ফুটবল দলকে ডায়েট ও প্রশিক্ষণেও সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে। পিএমআরডিএফ অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই মহিলা খেলোয়াড়দদের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় যদি এই খেলোয়াড়দের উপযুক্ত পরিকাঠামো দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো একটি বড় মাঠে এদেরও দেখা যাবে। এই আশাতেই সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
এক সময় প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট্ট পোশাক পরে মেয়েরা খেলবে নামবে দেখে ভ্রু কুঁচকেছিলেন অনেকেই। আপত্তি জানিয়েছিলেন বাবা-মাও। খেলার মাঠে পরিশ্রম না করে একশো দিনের কাজে যেতেও বাধ্য করা হয়েছিল সুস্মিতা-শিউলিদের। পরপর সাফল্য ও প্রশাসনিক সাহায্য মেলায় এখন অবশ্য সারা গ্রাম তাকিয়ে আছে তাঁদের দিকেই। সকলেরই আশা, এই মেয়েরাই হয়তো কেবল রাঙাডিহা নয়, বড় কোনও সাফল্য এনে জেলার নামও নতুন করে রাঙিয়ে দিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy