সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, মাথা পিছু মাসে ৮৫০ মিলিলিটার কেরোসিন বন্টন করা যায়। সেই মতো ঝাড়গ্রাম মহকুমার জনসংখ্যা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১১১৭ কিলোলিটার কেরোসিন পেলেই হয়ে যায়। অথচ জঙ্গলমহলের এই মহকুমার জন্য এত দিন বরাদ্দ আসত, ১৪৮২ কিলোলিটার (১ কিলোলিটার অর্থাত্ ১ হাজার লিটার)। অর্থাত্ ৩৬৫ কিলোলিটার অতিরিক্ত!
আবার খড়্গপুর মহকুমার জনসংখ্যা অনুযায়ী যেখানে ১৯৯৮ কিলোলিটার কেরোসিন তেল প্রয়োজন সেখানে সরকারি ভাবেই তেল আসত ২২০২ কিলোলিটার। অর্থাত্ প্রয়োজনের তুলনায় ২০৪ কিলোলিটার বেশি!
অর্থাত্ পশ্চিম মেদিনীপুরের এই দুই মহকুমার জন্য মাসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৫৬৯ কিলোলিটার কেরোসিন আসত। এই বাড়তি কেরোসিন সাধারণ গ্রাহককে বন্টন করার জন্য বলা হলেও বাস্তবে এর পুরোটাই প্রায় খোলা বাজারে চলে যেত বলে অভিযোগ। রেশনে যেখানে কেরোসিনের দাম প্রতি লিটার ১৫ টাকা ৩১ পয়সা, সেখানে খোলাবাজারে তা ৩০-৩৭ টাকায় লিটারে বিক্রি হয়। দীর্ঘ দিন এই অনিয়ম চলেছে বলে অভিযোগ। এ বার তাই অতিরিক্ত বরাদ্দ কিছুটা ছাঁটাই করল সরকার। জঙ্গলমহলের মাওবাদী প্রভাবিত ব্লকগুলি বাদে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাকি সব ব্লকে মাথা পিছু সম পরিমাণ কেরোসিন বিলির নির্দেশ ইতিমধ্যেই জারি করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ এমআর ডিলার জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সভাপতি কাঞ্চন খান বলেন, “২০০৮ সাল থেকে বাড়তি কেরোসিন জেলায় এসেছে। আর এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও আধিকারিক তা থেকে মুনাফা লুটেছেন। এ বার তাতে কিছুটা লাগাম দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে জেনে ভাল লাগছে। আমাদের দাবি, গরিবের বরাদ্দে ভাগ বসিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী যাতে কারচুপি না করতে পারেন, সে জন্য সরকার কড়া নজরদারি চালু করুক। নতুবা কোটি কোটি টাকার জালিয়াতি বন্ধ অসম্ভব।” পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা খাদ্য নিয়ামক পার্থপ্রতিম রায় অবশ্য জানিয়েছেন, “এ বার সরকার প্রতিটি মহকুমার জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জঙ্গলমহলের ১১টি ব্লক ও ঝাড়গ্রাম পুরসভার বাসিন্দাদের জন্য মাসে ৯০০ মিলিলিটার ও জেলার বাকি অংশের জন্য মাথাপিছু মাসে ৮৫০ লিটার কেরোসিন বরাদ্দ করা হচ্ছে। চলতি মাস থেকেই এই বরাদ্দ মেনে উপভোক্তাদের কেরোসিন দেওয়া হবে।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০০১২ সাল পর্যন্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বরাদ্দ কেরোসিনের পরিমাণ ছিল ৫৭৮৪ কিলোলিটার। যার মধ্যে খড়্গপুর মহকুমার জন্য বরাদ্দ ছিল ২২০২ কিলোলিটার ও ঝাড়গ্রামের জন্য ছিল ১৪৮২ কিলোলিটার। ২০১১ সালে জেলা খাদ্য দফতরের এক নির্দেশিকা অনুযায়ী (মেমো নং-১৪৩১/২/ডিসিএম/(ডব্ল্যু)/১১), ওই সময় দু’টি মহকুমা মিলিয়ে ৫৬৯ কিলোলিটার তেল বেশি বরাদ্দ করা হত। তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমায় রেশন কার্ড ভিত্তিক জনসংখ্যা ছিল ১২ লক্ষ ৭০ হাজার ১৭৪ জন। আর খড়্গপুর মহকুমায় জনসংখ্যা ছিল ২২ লক্ষ ৭৫ হাজার ৬৯ জন। মাথা পিছু ৮৫০ মিলিলিটার কেরোসিন দেওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ নষ্ট ও বিশেষ অনুমতি ক্রমে ঝাড়গ্রামের জন্য ৪ কিলোলিটার ও খড়্গপুরের জন্য ৬ কিলোলিটার ধরার পরেও ওই বৃহত্ পরিমাণ কেরোসিন অতিরিক্ত আসত। তাই ওই সময় মাথা পিছু বরাদ্দের পরিমাণও বাড়িয়েছিল সরকার। ঝাড়গ্রামের জন্য মাথা পিছু মাসে ১৩০০ মিলিলিটার, খড়্গপুরের জন্য ৯৫০ মিলিলিটার ও বাকি মেদিনীপুর ও ঘাটাল মহকুমার জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৮৫০ মিলিলিটার করে কেরোসিন বন্টনের নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। কিন্তু অভিযোগ, সাড়ে ৮০০ মিলিলিটারের বেশি কেরোসিন মেলেই নি। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা তথা মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্ম্মুর কথায়, “ কোথায় বেশি কেরোসিন! সপ্তাহে মাথা পিছু ২০০ মিলিলিটারের বেশি কেরোসিন কোনদিন মেলেনি। এমনকি মাঝে মধ্যে আবার কোনও সপ্তাহে কেরোসিন নেই বলে দেয় না পর্যন্ত। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষদের চুড়ান্ত সমস্যা হয়।’’ একই অভিযোগ খড়্গপুর মহকুমার বাসিন্দা তথা লোধা শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েকের। তাঁর কথায়, “আমাদের পক্ষে কী জানা সম্ভব যে, কোন মহকুমায় কত করে বরাদ্দ। আমাদের জন্য যে বেশি বরাদ্দ ছিল তা তো জানতামই না। সব দিন বঞ্চিতই থেকেছি!”
বারেবারেই এমন অভিযোগ গিয়েছে জেলা থেকে। কিন্তু তত্কালীন বামফ্রন্ট সরকার যেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি, তেমনি বর্তমান শাসক দলও তেমন কিছুই করেনি বলে অভিযোগ। তবে বর্তমানে অভিযোগের বহর বাড়ছে দেখে অবশ্য ২০১৩ সালে ৪৬ কিলোলিটার বরাদ্দ কমিয়ে জেলার জন্য কেরোসিন বরাদ্দ করা হয়েছিল ৫৭৩৮ কিলোলিটার। চলতি বছর থেকে বরাদ্দ আরও কিছুটা কমানো হয়েছে। আরও ৮৪ কিলোলিটার কমিয়ে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৬৫৪ কিলোলিটার। মহকুমা ভিত্তিক বরাদ্দও রদবদল করা হয়েছে। আগের থেকে জেলাতে জনসংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে। মানুষও কিছুটা সচেতন হয়েছে। তারই সঙ্গে আবার মহকুমা ভিত্তিক মাথাপিছু আলাদা বরাদ্দ নেই। জঙ্গলমহল বাদে বাকি সর্বত্রই বরাদ্দের পরিমাণ এক। ফলে এবার কারচুপি কিছুটা কমবে বলেই প্রশাসনিক কর্তাদের আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy