Advertisement
E-Paper

কলেজ দাপাচ্ছেন ‘বহিষ্কৃত’ টিএমসিপি নেতা

তিনি ছাত্র নন। কিন্তু ছাত্রদের হস্টেলে থাকেন। শুধু থাকেনই না, কলেজে ভর্তি থেকে পড়ুয়াদের হস্টেল পাওয়া— সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। বছর দুই আগে তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করেছে টিএমসিপি। কিন্তু গোটা ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ জানে, সেখানে সংগঠনটা কার্যত সৌমেন আচার্য ওরফে বুড়া-ই চালান। তাঁর মাথাতেই সংগঠনের জেলা নেতৃত্বের হাত। সেই জোরেই তিনি নিয়মিত হস্টেলে থাকেন। কলেজে দাদাগিরি চালান। আর সেই জোরেই এ বার হস্টেল সুপার তথা শারীরশিক্ষার শিক্ষক বাদলকুমার জানার কলার ধরে চড় কষাতে যাওয়ার অভিযোগ উঠল সৌমেনের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে গালিগালাজ। সুপারের অপরাধ, তিনি সৌমেনের দাবি মতো পড়ুয়াদের হস্টেল দিতে চাননি।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৭
সেই টিএমসিপি নেতা সৌমেন আচার্য।

সেই টিএমসিপি নেতা সৌমেন আচার্য।

তিনি ছাত্র নন। কিন্তু ছাত্রদের হস্টেলে থাকেন। শুধু থাকেনই না, কলেজে ভর্তি থেকে পড়ুয়াদের হস্টেল পাওয়া— সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন।

বছর দুই আগে তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করেছে টিএমসিপি। কিন্তু গোটা ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ জানে, সেখানে সংগঠনটা কার্যত সৌমেন আচার্য ওরফে বুড়া-ই চালান। তাঁর মাথাতেই সংগঠনের জেলা নেতৃত্বের হাত। সেই জোরেই তিনি নিয়মিত হস্টেলে থাকেন। কলেজে দাদাগিরি চালান।

আর সেই জোরেই এ বার হস্টেল সুপার তথা শারীরশিক্ষার শিক্ষক বাদলকুমার জানার কলার ধরে চড় কষাতে যাওয়ার অভিযোগ উঠল সৌমেনের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে গালিগালাজ। সুপারের অপরাধ, তিনি সৌমেনের দাবি মতো পড়ুয়াদের হস্টেল দিতে চাননি। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে, মঙ্গলবার ওই ঘটনার পরে টিচার্স কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হলেও পুলিশে অভিযোগ জানাতে পারেননি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

শেষমেশ বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রাম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিমাইচাঁদ মাসান্ত এবং বাদলবাবু কলকাতায় বিকাশ ভবনে গিয়ে ডিপিআই নিমাইচন্দ্র সাহার সঙ্গে দেখা করেন। তবে নিমাইবাবুর দাবি, তাঁরা কারও নামে কোনও অভিযোগ জানাননি। নিছকই দফতরের কাজ নিয়ে এসেছিলেন। তবে বিকাশ ভবনেরই অন্য সূত্রের খবর, সৌমেনের বিরুদ্ধে ঝাড়গ্রাম থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষকে। যদিও রাত পর্যন্ত তা করা হয়নি।

ঘটনাচক্রে, বাদলবাবু একেবারে সহায়সম্বলহীন ছাপোষা লোক নন। বরং তৃণমূল প্রভাবিত ‘অল বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কলেজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ ইউনিটের কোষাধ্যক্ষ তিনি। এ দিন তিনি বলেন, “যে ভাবে অপমানিত ও নিগৃহীত হয়েছি, তাতে আমি মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে কিছু আর বলতে চাই না।” টিএমসিপির রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র বলেন, “যে ছেলেটির নামে অভিযোগ সে টিএমসিপি-র কেউ নয়। দু’বছর আগেউ তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।”

দু’বছর আগে, ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলেজের অধ্যক্ষের গালেও সপাটে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল টিএমসিপি-র তদানীন্তন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সহ-সভাপতি সৌমেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার পরে অধ্যক্ষ কিশোরকুমার রাঢ়ী নিজেই বদলি হয়ে যান। এর পরে ফের লরি ভাঙচুর ও লুঠপাটে সৌমেনের নাম জড়ানোয় নেতৃত্ব চাপে পড়ে যান। সৌমেনকে দল থেকে ‘বহিষ্কার’ করা হয়।

কিন্তু তা যে বস্তুত লোক দেখানো শাস্তি, তা জেলা টিএমসিপি-র প্রায় সব নেতা-কর্মীই জানেন। ঝাড়গ্রাম কলেজের টিএমসিপি নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক দেবনাথ দে-র কথায়, “বুড়াদাই আমাদের কলেজ ইউনিট দেখাশুনো করেন।” ঠিক যেমন ‘সাসপেন্ড’ হয়েও দিব্যি দাপট দেখিয়ে চলেছেন নদিয়ার ভক্তবালা কলেজের টিএমসিপি নেতা তন্ময় আচার্য। বা তৃণমূল ‘সাসপেন্ড’ করলেও বহাল তবিয়তেই রয়েছেন ভাঙড়ের আরাবুল ইসলাম।

ঝাড়গ্রাম কলেজ সূত্রের খবর, এ বার হস্টেলে আবাসিক ভর্তি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতেই নিজের বাছাই করা পড়ুয়াদের নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করেছিলেন সৌমেন। কর্তৃপক্ষের একাংশের বক্তব্য, কলেজের কাছে বাড়ি এমন পড়ুয়াদের হস্টেল দেওয়ার জন্যই চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সুপার তা মানেননি। মঙ্গলবার শারীরশিক্ষা বিভাগে সদলবলে চড়াও হন সৌমেন। তার পরেও সুপার নতিস্বীকার না করায় তারা খেপে ওঠে। সেই সময়েই সৌমেন গালিগালাজ করে শিক্ষকের কলার চেপে ধরে বলে অভিযোগ। চড়ও মারতে যায়। সেই সময়ে অন্য শিক্ষকেরা ছুটে গিয়ে তাঁকে সরিয়ে আনেন।

কলেজের মধ্যে এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরাও। যদিও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। মন্তব্য করতে চাননি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিমাইবাবুও। ঘটনার পরেই তড়িঘড়ি টিচার্স কাউন্সিলের বৈঠক ডেকেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক আলোচনার পরেও পুলিশে অভিযোগ দায়ের নিয়ে সহমত হতে পারেননি সদস্যেরা। ইতিমধ্যে সৌমেনও শিক্ষক নিগ্রহের অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেন, “ওই সময়ে আমি কলেজেই ছিলাম না।” তাঁর আরও দাবি, বাদলবাবুই ইচ্ছে করে আদিবাসী ছাত্রদের হস্টেল দিচ্ছিলেন না। সেই কারণে মঙ্গলবার টিএমসিপি-র তরফে তাঁর কাছে দাবি জানানো হচ্ছিল।

ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবার বাসিন্দা, বিড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার মালিকের ছেলে সৌমেন দফায়-দফায় কয়েক বছর কলেজে পড়লেও স্নাতক হতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও জেলা নেতৃত্বের একাংশের, বিশেষ করে জেলা টিএমসিপি সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরির প্রশ্রয়েই তিনি কলেজে দাপিয়ে বেড়ান বলে অভিযোগ। কলেজ সূত্রের খবর, দু’টি ‘বয়েজ হস্টেলে’ কার্যত মৌরসিপাট্টা কায়েম করেছেন সৌমেন ও তাঁর দলবল। সৌমেনের মদতে রাতবিরেতে বহিরাগতেরা হস্টেলে থাকছে। শুধু তাই নয়, হস্টেলে নানা ধরনের আসামাজিক কাজকর্ম হচ্ছে। এ ব্যাপারে রাশ টানতে গিয়ে সৌমেনের কোপে পড়েন বাদলবাবু। সম্প্রতি হস্টেলে র্যাগিং ঠেকাতে প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ ও তৃতীয় বর্ষের আবাসিকদের তিনটি তলায় পৃথক ভাবে রাখতে উদ্যোগী হন বাদলবাবু। অভিযোগ, সৌমেন-বাহিনীর বাধায় তা করা যায়নি।

এখনও কি তিনি টিএমসিপি-তে আছেন? সৌমেনের জবাব, “এটা নেতারাই বলতে পারবেন।” বছর দু’য়েক আগেই সৌমেনকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়েও রমাপ্রসাদ বলেন, “কেউ যদি সংগঠনকে ভালবেসে কিছু করে, তাকে তো দোষ দেওয়া যায় না! এতে আমাদের কী করার আছে?”

অগস্টে ক্ষমতাসীন টিএমসিপি’র ছাত্র সংসদের সঙ্গে বিরোধে পদত্যাগ করেছিলেন ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের টিচার ইন চার্জ মঞ্জুষা সিংহ মহাপাত্র। তা জেনে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মঞ্জুষাদেবীকে ফোন করে ইস্তফাপত্র ফিরিয়ে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু মঞ্জুষাদেবী মত বদলাননি। মানিকপাড়া ছাড়াও বহু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএমসিপির ‘দাদাগিরির’ অভিযোগে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। এই তালিকার নতুন নাম ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ।

TMCP Jhargram Soumen Acharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy