জুলাই মাসে মালঞ্চ রোডের এখানেই অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মীর লক্ষাধিক টাকা ছিনতাই হয়। তারপরেও এখনও শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তায় কদাচিৎ পুলিশের দেখা মেলে।
বদলায়নি কিছুই।
রেলশহরে একের পর এক চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়তে থাকলেও নিরাপত্তা সেই তিমিরেই। রেলের ছাঁট লোহার কারবার আর ঠিকাদারি নিয়ে মাফিয়ারাজের পাশাপাশি এখন শহরে দাপট বেড়েছে চোর, ছিনতাইবাজদের। প্রকাশ্য রাস্তায় বন্দুক দেখিয়ে চলছে লুঠপাট। কিনারা হয়নি অধিকাংশ ঘটনারই। উদ্ধারও করা যায়নি ছিনতাই হওয়া সামগ্রীও। শহরের মালঞ্চ ও ইন্দায় টহলরত লাঠিধারী পুলিশের দল যেন নিধিরাম সর্দার। পুলিশের একটিই দল পাহারা দেওয়ায় রাতে কদাচিৎ দেখা মেলে তাঁদের।
কী বলছে শহরবাসী? রেলের রেকে আসা ছাঁট লোহার কারবার আর লাভজনক ঠিকাদারির দখল নিয়েই শহরে অপরাধের সূত্রপাত। সেই দখলদারি নিয়েই নব্বইয়ের দশক থেকে উত্থান বাসব রামবাবুর। ১৮৯৮ সালে রেল কারখানা স্থাপনের পর থেকে ক্রমে আড়ে বহরে বেড়েছে খড়্গপুর। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কাজের খোঁজে শহরে আসা লোকেদের একাংশ হাত পাকায় ছিনতাইয়ের মতো অপকর্মে।
বছর তিরিশ আগেও এই শহরে ধারাবাহিক খুনের ইতিহাস সে ভাবে পাওয়া যায় না। শহরবাসীর মতে, রেলের ঠিকাদারি নিয়ে গোলমাল থেকেই এই শহরের অপরাধের তালিকায় সংযোজিত হয়েছে খুন। আর সেই সূত্রে উঠে এসেছে রেলনগরীর ত্রাস বাসব রামবাবুর নাম। রামবাবু একাধিক ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে সাত বছর জেলে কাটিয়েছেন। ২০১১ সালে আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় মাকাতপুরে রামবাবুর কনভয়ে ওপর হামলা চলে। সেই ঘটনায় রামবাবু একদা তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত শ্রীনু নাইডু ওই ঘটনায় যুক্ত বলে দাবি করেছিলেন। যদিও তাঁরা দু’জনেই নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার কথা অস্বীকার করেছেন। রামবাবুর কথায়, “আগের মতোই ঠিকাদারির ব্যবসা করছি। তবে আমি বা আমার দলের লোকেরা কোনও গোলমালে নেই।” শ্রীনু নাইডু বলেন, “শান্তিতে ঠিকাদারির ব্যবসা করছি। তবে আমার এলাকায় যাঁরা কালোবাজারি করবে, তাঁদের বরদাস্ত করব না।” যদিও রাজনীতিতে যাওয়ার প্রসঙ্গে রামবাবু বলেন, “রাজনীতিতে গেলে সকলকে জানিয়েই যাব।”
ছিনতাইবাজদের ভয়ে শহরের আইআইটি যাওয়ার এই রাস্তা এড়িয়ে চলেন শহরবাসী।
শহরবাসীর অনেকের মতে, খড়্গপুরের পাঁচবেড়িয়া, বিদ্যাসাগরপুর, পীরবাবা, পুরাতনবাজার এলালায় নিষিদ্ধ নেশার দ্রব্যের রমরমা বাড়ছে। নেশার টাকার সংস্থার করতে গিয়েই যুবসম্প্রদায় জড়িয়ে পড়ছে নানা অসামাজিক কাজের সঙ্গে। শহরের বুলবুলচটির বাসিন্দা চামেলি সরখেল, মালঞ্চর বাসিন্দা পাপিয়া সেন বলেন, “এখন রাত বাড়লে শহরের পথে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা সঙ্গে নিয়ে বেরোতে ভয় লাগে। ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে ফিরতে দেরি করলে খুব চিন্তা হয়। শহরবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশের আরও কঠোর হওয়া উচিত।”
সাম্প্রতিক কালে শহরে ঘটে যাওয়া চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় তদন্তে নেমে কী বলছে পুলিশ। কী বক্তব্য শহরের বাসিন্দাদের:
পুরাতনবাজার: গত ২৮ অক্টোবর রাতে ওই বাজারের তিনটি দোকানে ও স্থানীয় শীতলা মন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় তদন্তে নেমে পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। হদিস মেলেনি চুরি হওয়া টাকা ও দ্রব্যেরও। শীতলা মন্দির কমিটির সহ সম্পাদক দীনেশ শীট বলেন, “২০১২ সালেও একইভাবে মন্দিরে চুরি হয়েছিল। তারপর প্রশাসন কিছুটা সক্রিয় হলেও তা ছিল সাময়িক। তাই ফের মন্দিরের প্রণামী বাক্স ভেঙে চুরির ঘটনা ঘটল। এখন পুলিশ কিছুটা সজাগ রয়েছে। তবে এটা কতদিন থাকে সেটাই প্রশ্ন।” দক্ষিণ পুরাতন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুবীর সরকারের কথায়, “পুরাতনবাজার মোড়ে পুলিশ পিকেট থাকা সত্বেও তিনটি দোকানে চুরির ঘটনায় স্থানীয় দোকানদাররা এখনও ক্ষুব্ধ। পুলিশি নিরাপত্তা সেভাবে চোখে পড়ছে না।” তিনি বলেন, “নিরাপত্তার অভাববোধ রয়েছেই। তাই আমরা নিজেরাই নিরাপত্তারক্ষী রাখার বিষয়ে চিন্তা করছি।” পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। দুষ্কৃতীদের ধরতে তল্লাশি চলছে।
ইন্দা: ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ফেরার পথে আইআইটি’র অবসরপ্রাপ্ত কর্মী রঞ্জিতকুমার দত্তের কাছ থেকে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। রঞ্জিতবাবু পুলিশের কাছে দুষ্কৃতীদের চেহারার বিবরণ দেন। ব্যাঙ্কের সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখে পুলিশ। তারপরে এখনও দুষ্কৃতীরা অধরাই। রঞ্জিতবাবু বলেন, “ঘটনার পর এক মাস হতে চলল। প্রায় রোজই থানায় গিয়ে খোঁজ নিই। পুলিশ দেখছি, দেখব করছে। কিন্তু টাকা পাওয়ার আশা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “ওই ঘটনায় অল্প টাকা নিয়ে রাস্তায় বেরোতে ভয় হচ্ছে।”
সাত নম্বর রেল কলোনি: ২০ অক্টোবর ওই এলাকায় ছিনতাই করতে এসে গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। ওই ঘটনায় সোনার দোকানের কর্মী প্রদীপ ধাওয়াল পুলিশি জটিলতায় ভয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। তবে ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ একজনকে আটক করে। পরে তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়। তদন্তের অগ্রগতি বলতে ওইটুকুই।
পাশাপাশি, শহরের সুভাষপল্লি, ভবানীপুর, ছোট ট্যাংরার গলিপথে বাড়ছে অসামাজিক কাজকর্মের রমরমা। এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই অপরিচিত যুবকদের আনাগোনা বাড়ে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুভাষপল্লির এক বাসিন্দার কথায়, “প্রতিদিন রাত দু’টো পর্যন্ত পাড়ার মধ্যে অপরিচিত যুবকদের নিজেদের মধ্যে বচসা চলতে থাকে। এমনকী এলাকারও কিছু যুবক তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবাদ করলেই সহ্য করতে হয় অশালীন ব্যবহার। এই গলিপথে পুলিশের দেখা মেলাই ভার।”
সাম্প্রতিক কালে শহরের বিদ্যাসাগরপুর ও ফরিরমহল্লা এলাকায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব বেড়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। বিদ্যাসাগরপুর এলাকার বাসিন্দা জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাজা রায় বলেন, “বিদ্যাসাগরপুর এলাকা দুষ্কৃতীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পুলিশ মাঝে-মধ্যে গলিপথে টহল দিতে আসে। তবে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো দরকার।”
পুলিশ কী বলছে? খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর বলেন, “অন্য শহরের তুলনায় খড়্গপুরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের যাতায়াত বেশি। আগের তুলনায় শহরে অপরাধমূলক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেই মনে করি।” শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বর্তমানে শহরে যেসব বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে, তার পিছনে শহরের পাশাপাশি বাইরের দুষ্কৃতীদের যোগও রয়েছে। তদন্ত চলছে।” দুষ্কৃতীদের রুখতে পুলিশ কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? উত্তরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। টহল আরও বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমরা রেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছি, যাতে রেল স্টেশনগুলি থেকে যে সমস্ত মানুষ শহরে ঢুকছে তাঁদের উপর নজরদারি বাড়ানো যায়।”
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy