আট মাস কারখানা বন্ধ। চরম সমস্যার মুখে ‘কেশর মাল্টিয়ার্ন মিল লিমিটেড’-এর প্রায় আটশো শ্রমিক। অনেকের বাড়িতেই এখন নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মতো পরিস্থিতি। কেউ অস্থায়ী ভাবে অন্য কোনও কাজ খুঁজে নিয়েছেন। কেউ আবার কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। ইতিমধ্যে কারখানা খোলা নিয়ে কলকাতায় শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু জট পুরোপুরি কাটেনি। সামনে পুজো। মেদিনীপুরের বিধায়ক মৃগেন মাইতির অবশ্য আশ্বাস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কারখানাটি চালু হবে। শ্রমিকদের আশা, পুজোর আগে সুতোকল খুলবে। তাঁদের পরিবারের লোকেদের মুখে হাসি ফুটবে। অবশ্য পুজোর আগে সুতোকল খোলা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কলকাতার ওই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মৃগেনবাবুও ছিলেন। তিনি বলেন, “কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। মন্ত্রীও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আলোচনা ফলপ্রসূই হয়েছে। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি কারখানাটি চালু হবে।” তাঁর কথায়, “প্রায় আট মাস হল কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের সমস্যার কথা আমাদের অজানা নয়। আমার তরফ থেকে যা যা পদক্ষেপ করা সম্ভব আমি তাই তাই পদক্ষেপই করছি।” ডেপুটি লেবার কমিশনার (খড়্গপুর) শ্যামল দত্তরও বক্তব্য, “ইতিমধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কারখানা খোলা নিয়েই আলোচনা হয়েছে।”
মেদিনীপুর শহরের তাঁতিগেড়িয়ায় ‘কেশর মাল্টিয়ার্ন মিল লিমিটেড’ নামে ওই সুতোকলটি রয়েছে। ১৯৬৪ সালে সুতোকলটি গড়ে ওঠে। পরে অবশ্য মালিকানা বদল হয়েছে। শহরের এই পুরনো সুতোকলটি গত জানুয়ারি মাস থেকে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় আটশো শ্রমিক কাজ করতেন। সকলেই এখন কাজহারা। বন্ধ সুতোকল খোলার জন্য আগেও কখনও কলকাতায়, কখনও খড়্গপুরে শ্রম দফতরের আধিকারিকেরা দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। অবশ্য সমস্যার সমাধান হয়নি।
ঠিক কী পরিস্থিতিতে দিন গুজরান করছেন কাজহারা শ্রমিকেরা এবং তাঁদের পরিবার?
প্রায় চোদ্দো বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করতেন বিকাশ দাস। বিকাশবাবুর দুই ছেলে। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে। তাঁর কথায়, “কী ভাবে যে সংসার চালাচ্ছি বলে বোঝাতে পারবো না। এখন দুই ছেলের পড়াশোনার খরচও জোগাতে পারছি না। কোনও রকমে দিন কাটছে। অস্থায়ী ভাবে মজুরের কাজ করছি। কাজ করলে দিনে ১৮০ টাকা পাই। এই দিয়ে কী আর সংসার চলে?” বিকাশবাবু বলেন, “পুজোর আগে কারখানা খুললে ভাল হয়। না হলে দুই ছেলেকে নতুন পোশাকও কিনে দিতে পারবো না।”
কর্তৃপক্ষ ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’- এর নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়ার পর থেকে দফায় দফায় আন্দোলন করেছেন শ্রমিকেরা। একাধিক শ্রমিক সংগঠনও পথে নেমেছে। শাসক দল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত এই কারখানার শ্রমিক ইউনিয়ন তো আবার কারখানা খোলার দাবিতে জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ- কর্মসূচিও করেছে। সিটু নেতা সারদা চক্রবর্তীর দাবি, “রাজ্য সরকারের শিল্পনীতির জন্যই একের পর এক কারখানার শ্রমিকেরা রুজিরুটি হারাচ্ছেন। মেদিনীপুরের এই কারখানা তারই একটি।” তাঁর কথায়, “আট মাস হল একটা কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। শ্রমিকদের সমস্যা তো হবেই।” আইএনটিটিইউসি নেতা শশধর পলমল বলেন, “আমরাও অবিলম্বে কারখানা খোলার দাবি জানিয়েছি। শ্রমিকেরা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। অনেকে বাড়িতে দু’বেলা খেতে পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে পারে না।”
শশধরবাবু বলেন, “আমরা ফের শ্রমমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছি।” শুধু মেদিনীপুর শহরের এই কারখানা নয়, খড়্গপুর শিল্পতালুকের কিছু কারখানাও এখন ধুঁকছে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যে পালাবদলের পর গত তিন বছরে পশ্চিম মেদিনীপুরে নতুন শিল্পের প্রসার প্রায় বন্ধ। নতুন কারখানা তো চালু হচ্ছেই না, উল্টে একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হচ্ছে। জিন্দলদের প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানা হওয়ার কথা ছিল শালবনিতে। নানা কারণে এখনও পর্যন্ত তার কাজ সেভাবে এগোয়নি। খড়্গপুর শিল্পতালুকে বহু জমি পড়ে রয়েছে। নতুন শিল্প আসছে না। অথচ, বিগত বাম আমলে শিল্পায়নের জন্যই এখানে জমি অধিগ্রহন করা হয়েছিল। গত আট মাসে মেদিনীপুরের ওই সুতোকলের কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কয়েকজন নানা অসুখে ভুগছেন। দ্রুত কারখানা না খুললে আরও সমস্যার মুখে পড়বেন শ্রমিকেরা।
এখন পুজোর আগে বন্ধ কারখানা খোলে কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy