Advertisement
১৬ মে ২০২৪

নতুন নক্ষত্রের আলোয় ম্লান পুরনো তারারা

তখন সবে ভোটের ঢাকে পড়েছে। শুরু হয়েছে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা। মেদিনীপুর নিয়ে তখন থেকেই মুখে মুখে ফিরছিল, ‘পূর্বে পিতাপুত্র। পশ্চিমে চলচ্চিত্র।’ হালকা চালের সেই কথাটাই বাস্তবে মিলে গেল। পোড়খাওয়া রাজনীতিক থেকে বিদায়ী সাংসদ সকলেই হেরে গেলেন চিত্রতারকাদের কাছে।

জয়ের পর জনতাকে প্রণাম। খড়্গপুরে সন্ধ্যা রায়। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

জয়ের পর জনতাকে প্রণাম। খড়্গপুরে সন্ধ্যা রায়। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০১:৫৮
Share: Save:

তখন সবে ভোটের ঢাকে পড়েছে। শুরু হয়েছে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা। মেদিনীপুর নিয়ে তখন থেকেই মুখে মুখে ফিরছিল, ‘পূর্বে পিতাপুত্র। পশ্চিমে চলচ্চিত্র।’

হালকা চালের সেই কথাটাই বাস্তবে মিলে গেল। পোড়খাওয়া রাজনীতিক থেকে বিদায়ী সাংসদ সকলেই হেরে গেলেন চিত্রতারকাদের কাছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সাংসদ হিসাবে বেছে নিলেন দেব, সন্ধ্যা রায়ের মতো তারকাদের।

শুক্রবার ভোট গণনা শুরু হতেই তৃণমূল নিশ্চিত হয়ে যায়, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিরোধীদের কোনও জায়গা নেই। প্রার্থীরা নতুন, অরাজনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও জয় নিশ্চিত। তবু সকাল থেকেই প্রার্থীদের নজর ছিল টিভির পর্দায়। সেই সঙ্গে ঘনঘন ফোনে পরিস্থিতির খোঁজ রাখছিলেন। দেব দুপুর ১২টা নাগাদ ঘাটাল পৌঁছন। প্রথমেই ভাড়া নেওয়া বাড়িতে গিয়ে চা, বিস্কুট খেতে খেতেই টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র ও ঘাটালের

সবিস্তারে দেখতে
ক্লিক করুন...

বিধায়ক শঙ্কর দোলুই হাজির হন তাঁর কাছে। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গণনাকেন্দ্রে। আগে থেকেই অবশ্য হাজির ছিলেন অন্য দুই প্রার্থী বামফ্রন্টের সন্তোষ রাণা ও কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। তবে একটি বারের জন্যও কোনও রাউন্ডেই দেবকে হারাতে পারেননি। কেবলমাত্র সবংয়েই দেবের থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন সন্তোষ রাণা। সন্ধ্যা রায়ও আগের দিনই মেদিনীপুরে এসে গিয়েছিলেন। তবে বাড়ি থেকে বেরোননি। কিছুক্ষণ গণনার পরেই যখন দেখলেন, জয়ের পথ পরিষ্কার, তখনই গণনাকেন্দ্রে গেলেন। তবে আধ ঘন্টার বেশি গণনাকেন্দ্রে থাকেননি। দিনের শেষে খড়্গপুরের গণনাকেন্দ্রে এসে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক তথা জেলাশাসকের কাছ থেকে শংসাপত্র নেন তিনি। পরে সাংবাদিক বৈঠকে সন্ধ্যাদেবী বলেন, “আমার জয় দলের কর্মী-সমর্থকদের উৎসর্গ করছি। মেদিনীপুরের জন্য অনেক কিছু করার রয়েছে। জনসাধারণের সাহায্যকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।”

ঘাটাল ও মেদিনীপুর। দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের দু’রকম তাৎপর্য রয়েছে। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রটি সিপিআইয়ের দুর্গ বলেই পরিচিত ছিল। যদিও পরবর্তীকালে বড় শরিক সিপিএমের আগ্রাসন নীতি সিপিআইয়ের সংগঠনকে তলানিতে নামিয়ে এনেছিল। পরিবর্তে সিপিআইয়ের কর্মী সমর্থকদের নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের দলে। তবু বামফ্রন্টের নীতি মেনে এই আসনটি সিপিআইয়ের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। যে আসনে কেরলের ভি কে কৃষ্ণমেনণ থেকে এক সময়ের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তও জয়ী হয়েছিলেন। তখন বিরোধী তৃণমূল আওয়াজ তুলেছিল, সাংসদকে এলাকায় দেখা যায় না। নির্বাচনী প্রচারে এসে প্রকাশ্য পথসভাতে ইন্দ্রজিৎবাবু বক্তব্য রাখতে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে দিল্লিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মেদিনীপুরে থাকার মতো তাঁর সময় নেই। তাতে ইচ্ছে হলে মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন, না হলে না দেবেন। এই বক্তব্যে দল কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়লেও, সংগঠনের জোরে ইন্দ্রজিৎবাবুই কিন্তু জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচন হয়। তখনই প্রথম প্রবোধ পাণ্ডার নির্বাচনী লড়াই। উপনির্বাচন নিয়ে পরপর তিনবারের সাংসদ তিনি। ২০০৪ সালে যেখানে দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন, সেখানে ২০০৯ সালে তৃণমূল ঝড়ে জয়ের ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫০ হাজারে। তবু বামফ্রন্ট এই আসনে জয় নিশ্চিত বলেই ধরেছিল। তার প্রধান কারণ, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন। যেখানে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট থাকা সত্ত্বেও সাতটি বিধানসভার মধ্যে চারটিতেই জয় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল বামফ্রন্ট। এবার জোট ছিল না। তারকা প্রার্থী নিজে তেমন প্রচার করতেও পারেননি। তার উপর কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে, দলেও প্রচণ্ড গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। নানা অঙ্ক কষেই এই ভাবনায় এসেছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু সব অঙ্কই উল্টে দিয়ে তারকা প্রার্থীই বিপুল ভোটে জয় পেলেন এই কেন্দ্রে।

ঘাটাল লোকসভায় বরাবর জিতেছে সিপিআই। এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস দাশগুপ্তরা। উপ-নির্বাচনে একবারই তৃণমূল প্রার্থী বিক্রম সরকার জিতেছিলেন। তারপর ফের বিপুল জয় পায় বামেরা। ২০০৪ সালে প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার ভোটে জেতেন গুরুদাসবাবু। কেশপুর থেকেই লিড ছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ৯৮০। ২০০৯ সালে জয়ের ব্যবধান কিছু কমলেও কেশপুরের সৌজন্যে প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে জয় এসেছিল। এ বার কেশপুর, গড়বেতা, নারায়ণগড়ের সেই বাম দুর্গ ধূলিসাৎ। রুপোলি পর্দার তারকাদের কাছে শেষমেশ হার মানলেন রাজনীতির পুরনো তারারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

suman ghosh medinipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE