শেষ কবে এমনটা হয়েছে, মনে করতে পারছেন না অনেকেই!
শেষ বেলায় পুলিশ তৎপর হতে শব্দদানব উধাও হয়ে গেল কলেজ মোড় থেকে। অথচ, কলেজ মোড়ের পুজো মানেই যেন শব্দদূষণ। শব্দের তীব্রতায় সব কিছুর তাল কেটে যাওয়া। শব্দ তাণ্ডবের হাত থেকে রক্ষা পেতে কানে হাত দিয়ে পুজো দেখা।
এ বারও শুরু হয়েছিল এ ভাবেই। ফলে, অসন্তোষ দেখা দেয় শহরবাসীর মধ্যে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ‘এত আওয়াজের মধ্যে পুজো দেখা সম্ভব? এ ভাবে পুজো করার থেকে না করাই ভাল!’ পরিস্থিতি দেখে পুজোর দিন অর্থাৎ রবিবার দুপুরের পর থেকে সক্রিয় হয় পুলিশ। সাদা পোষাকের পুলিশও কলেজ মোড়ে নজরদারি চালাতে শুরু করে। বেশ কয়েক’টি পুজো কমিটিকে সতর্ক করা হয়।
পুলিশের ধমক খেয়ে বিকেলের দিকে কয়েক’টি পুজোর উদ্যোক্তারা স্পিকার কমিয়ে নেন। পরে আরও তৎপর হয় পুলিশ। পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে গিয়ে পুলিশ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, শব্দবিধি মেনে চলতেই হবে। কোনও রকম উৎশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা হবে না। শুধু কথার কথা নয়, কয়েকটি সাউন্ড বক্স বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। এরপরই টনক নড়ে পুজো উদ্যোক্তাদের। যার নিট ফল, রবিবার রাতে আর সোমবার দিনভর স্বস্তিতেই বাগদেবীর পুজো দেখেছেন দর্শকেরা।
শহরের বাসিন্দা তমাল মাইতি, কৃষ্ণেন্দু দাসেরা বলছেন, “পুলিশের এই ভূমিকাটাই আমরা আশা করি। অনেক বছর পর কলেজ মোড়ের পুজোয় শব্দের দৌরাত্ম্য কম দেখলাম। এত জোরে সাউন্ড বক্স বাজে যে বক্সের আওয়াজ যেন বুকে এসে লাগে। এত আওয়াজের মধ্যে পুজো দেখা সত্যিই সম্ভব নয়।”
পুলিশের সক্রিয়তার পর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও একের পর এক মন্তব্য উঠে এসেছে। যেমন কেউ লিখেছেন, ‘মেদিনীপুর শহরের এক জন নাগরিক হিসেবে অনেক দিন পর সরস্বতী পুজোর দিন কলেজ স্কোয়ারে শব্দদানবহীন পুজো দর্শন করলাম। এক জন দর্শনার্থী বন্ধুর অকপট স্বীকারোক্তি, সব কৃতিত্ব পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ এবং কোতয়ালি থানা পুলিশের।’ আবার কেউ লিখেছেন, ‘সরস্বতী পুজোর দু’দিন মেদিনীপুর শহরের কলেজ স্কোয়ারকে শব্দদানবের ভয়ানক আক্রমণ থেকে রক্ষা করা ও পুরনো সাবেকী সাংস্কৃতিক ছন্দ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।’
মেদিনীপুর শহরের কলেজ মোড়ের পুজো দেখার জন্য অনেকে বছরভর অপেক্ষা করে থাকেন। রাজনীতির আকচাআকচিই এই পুজোর মূল আকর্ষণ। পুজো মণ্ডপে বিভিন্ন মডেল থাকে। কোনটা মাটির তৈরি। কোনটা প্লাইউডের। পাশে ব্যাঙ্গাত্মক লেখা থাকে। এখন অবশ্য ফ্লেক্সেই বেশি ব্যাঙ্গচিত্র আঁকা হয়। এই ব্যাঙ্গাত্মক লেখাগুলো দেখতেই ভিড় জমে। এক-একটি পুজো দেখতে বেশ কিছুক্ষণ সময়ও লাগে। তবে শব্দ- তাণ্ডব যেন সব কিছুর তাল কেটে দেয়। গোড়ায় এ বারও যেমনটা দিয়েছিল। পুজোর দিন সকালে কোনও মণ্ডপে ১২টি, কোনও মণ্ডপে ১৬টি সাউন্ড বক্স বেজেছে। বিকট শব্দে বক্সগুলো বাজার ফলে পুজো দেখতে এসে অনেকে সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে ছোট এবং বয়স্করা।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী দিনে কলেজ মোড়ে দর্শক সংখ্যা কমে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকে। শুধু সাধারণ মানুষ নন, এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাংশ পুজো উদ্যোক্তাও। কলেজ মোড়েরই যুববাণী সঙ্ঘের পুজো মণ্ডপে যেমন একটি ব্যানার লাগানো হয়। যেখানে লেখা ছিল, ‘ফিরিয়ে দাও কলেজ স্কোয়ারের সেই পুরনো ছন্দ, চেনা পরিবেশ। দর্শকরা আবার শান্তিতে প্রতিমা, মডেল দর্শন করে উপভোগ করুক। তা না- হলে এক দিন দর্শক শূন্য হয়ে পড়বে ঐতিহ্যবাহী কলেজ স্কোয়ার।’
আগেই পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সকলকেই শব্দবিধি মেনে চলতে হবে। তা না মানলে পুজো কমিটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তাই পুজোর দিন সকাল থেকে যথারীতি শুরু হয় শব্দ তাণ্ডব। পরে অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়। জেলা পুলিশের এক অফিসার বলছেন, “সপরিবার পুজো দেখতে বেরিয়ে বাচ্চা হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ভিড়ের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেই। তখন উদ্বেগের শেষ থাকে না। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে বাচ্চা খুঁজে পাওয়াও তো সহজ নয়। বিশেষ করে যদি বিকট আওয়াজে বক্স বাজে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ অফিসারের কথায়, “এ বার কড়া হাতেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হয়েছে। কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার থাকে না। এ বার ওই সব বাধ্যবাধকতাগুলো সামনে আসেনি। এর ফলেই কলেজ স্কোয়ারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে।”
কী বলছেন পুজো উদ্যোক্তারা?
শহরের এই এলাকায় প্রায় কুড়িটি পুজো হয়। প্রায় প্রতিটি পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে কোনও না- কোনও রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কোথাও পুজোর নেপথ্যে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, কোথাওবা ছাত্র পরিষদ। আবার কোথাও বা এসএফআই কিংবা এবিভিপি। ছাত্র পরিষদ প্রভাবিত পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে ‘প্রগতি’ ক্লাবের পুজো অন্যতম। ক্লাবের অন্যতম সদস্য সিপি নেতা মহম্মদ সইফুল বলেন, “আমরা তো জোরে সাউন্ড বক্স বাজাইনি। পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতাই করেছি।”
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ প্রভাবিত পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে ‘অগ্নিকন্যা’ ক্লাবের পুজো অন্যতম। ক্লাবের অন্যতম সদস্য টিএমসিপি নেতা বুদ্ধ মণ্ডলও বলেন, “আমরাও শব্দবিধি মেনে বক্স বাজিয়েছি। পুলিশের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করেছি।”