Advertisement
০৯ মে ২০২৪

পশংগড়ার ঘাটে ভিড়ত বাণিজ্যতরী

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ঘাটকে কেন্দ্র করে এই জনপদে গড়ে উঠেছিল নামী, অনামী বহু বাণিজ্য নগরী। নদী-খালের তীরে গড়ে ওঠা সেই সব জনপদ-নগরী কোথাও টিকে রয়েছে কোথাওবা অবলুপ্তির পথে। এই রকমই টিকে থাকা এক জনপদের উদাহরণ আজকের পাঁশকুড়া শহর।

এই সদর ঘাটেই বাঁধা থাকত স্টিমারের নোঙর। পিছনে শুকিয়ে যাওয়া কংসাবতী। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

এই সদর ঘাটেই বাঁধা থাকত স্টিমারের নোঙর। পিছনে শুকিয়ে যাওয়া কংসাবতী। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

আনন্দ মণ্ডল
পাঁশকুড়া শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২৫
Share: Save:

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ঘাটকে কেন্দ্র করে এই জনপদে গড়ে উঠেছিল নামী, অনামী বহু বাণিজ্য নগরী। নদী-খালের তীরে গড়ে ওঠা সেই সব জনপদ-নগরী কোথাও টিকে রয়েছে কোথাওবা অবলুপ্তির পথে। এই রকমই টিকে থাকা এক জনপদের উদাহরণ আজকের পাঁশকুড়া শহর।

ইতিহাস গবেষকদের মতে, পাঁশকুড়া নামে পূর্ব মেদিনীপুরে কোনও গ্রাম কিংবা জনপদ নেই। তাঁরা জানাচ্ছেন, কংসাবতীর নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা কাশীজোড়া পরগনাই আজকের পাঁশকুড়া। কেমন ছিল আগের পাঁশকুড়া? রূপনারায়ণের তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন বন্দর-বাণিজ্য নগরী তাম্রলিপ্তের পশ্চিম দিকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত প্রাচীন কাশীজোড়া পরগণা। জনপদের মাঝ বরাবার বয়ে চলছে কংসাবতী। রূপনারায়ণ আর কংসাবতীর সন্নিহিত অঞ্চলই এক কালে পরিচিত ছিল মণ্ডলঘাট ও কাশীজোড়া পরগণা নামে। গবেষকদের মতে, পাঁশকুড়ার পূর্ব নাম কাশীজোড়া পরগণা ছিল ওড়িশার অন্তর্গত। এই কাশীজোড়া নাম এসেছে জোড়া কাঁসাই থেকে।

আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক শ্যামল বেরা বলেন, “মেদিনীপুর ক্যানেল (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কৃষকদের চাষের সুবিধা এবং যোগাযোগ ও বাণিজ্যের সুবিধের জন্য এই ক্যানেল কাটা হয়) দিয়ে যাতায়াত করা স্টিমারগুলি কংসাবতীর তীরের (বর্তমানে দক্ষিণ গোপালপুর মৌজা) কাছে এসে এক জায়গায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত তুষের বর্জ্য ছাই (পাঁশ) ফেলত। সেই থেকেই ওই এলাকার নামকরণ পাঁশকুড়া হয়েছে বলে মনে হয়।” গবেষকদের অন্য একটি অংশের আবার মত, পশংগড়া থেকে পাঁশকুড়া নাম এসেছে। কারণ এক কালে জলসেচের সুবিধার্থে মেদিনীপুর ক্যানেলের এই এলাকায় লকগেট বা পশং তৈরি করা হয়েছিল। লকগেট সংলগ্ন স্থান হল ‘পশংগোড়া’। তার থেকেই পাঁশকুড়া নামটি এসেছে বলে অনুমান।

পাঁশকুড়া সদরঘাট সংলগ্ন এলাকায় ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এলাকার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রাডলি বার্ট হাইস্কুলের প্রহরীদের ব্যাজে ইংরাজিতে ‘punchcoora school’ এর উল্লেখ রয়েছে। আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক তথা অধ্যাপক গোবিন্দপ্রসাদ কর বলেন, “প্রাচীনকাল থেকে এলাকায় পাঁশকুড়া নামে কোন গ্রাম বা জনপদ না থাকলেও পাঁশকুড়া নামে আজকে যে এলাকা পরিচিত তা-ও কিন্তু অনেক পুরানো। প্রায় দেড়শ বছরেরও আগে ইংরেজ শাসনকালে তত্‌কালীন মেদিনীপুরের কালেক্টর এইচভি বেইলি ১৮৫২ সালে তাঁর লিখিত ‘মেমোরান্ডা অফ মিডনাপুর’-এ কংসাবতী তীরবর্তী এই এলাকাকে পাঁচকুড়া ঘাট (panchkoora ghat ) বলে উল্লেখ করেছেন। পরে সমগ্র কাশীজোড়া পরগণার নাম পরিবর্তিত হয়ে পাঁশকুড়া নাম হয়, মত তাঁর।

এক কালে কাশীজোড়া পরগণার শাসক ছিলেন উত্তর ভারতের সিরহন্দ থেকে আসা গঙ্গানারায়ণ রায় ও তাঁর উত্তরসূরিরা। ১৫৭৩ সালে কাশীজোড়া পরগনার জায়গিরদার হন গঙ্গানারায়ণ রায়। তাঁর রাজধানী ছিল কংসাবতী তীরবর্তী চম্পকনগর এলাকায় (বর্তমানে চাঁপাডালি)। পরবর্তী সময়ে রাজধানী গড়পুরুষোত্তমপুর, হরশঙ্কর, রাজবল্লভপুর ও সুন্দরনগরে স্থানান্তরিত হয়। কাশীজোড়া পরগণার শাসকদের হাতে বিভিন্ন জনপদের নামেই পাঁশকুড়ার প্রতাপপুর, পুরুষোত্তমপুর, হরিনারায়ণচক, সুন্দরনগর প্রভৃতি গ্রামের নাম হয় বলে গবেষকদের অনুমান।

ইতিহাসের সরণি বেয়ে সময়ের সঙ্গে বদলেছে শাসকদের উত্তরসূরি। মুঘল আমলের শেষ দিকে বাংলার নবাব মীরকাশিমের হাত হতে ১৭৬০ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুরের শাসন ভার চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ব্রিটিশ শাসনাধীন কোম্পানির আমলে কৃষকদের চাষের সুবিধার পাশাপাশি যোগাযোগ ও বাণিজ্যের তাগিদে ১৮৫২ সাল নাগাদ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ইরিগেশন অ্যান্ড ক্যানাল কোম্পানি’ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া থেকে মেদিনীপুরের মোহনপুর পর্যন্ত যে মেদিনীপুর ক্যানাল খনন করে তা এই কাশীজোড়া পরগণার উপর দিয়েও যায়। এ সময়ই কাশীজোড়া পরগণার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া কংসাবতী নদীর পূর্বতীরে এই মেদিনীপুর ক্যানালের সংযোগ স্থলে গড়ে ওঠে পাঁশকুড়া ঘাট।

পাঁশকুড়া ঘাট-এর সেই অস্তিত্ব হয়ত আজ নেই। তবে এখনও পাঁশকুড়া পুরাতন বাজারে থানার অফিসের সংলগ্ন সেচ দফতরের তৈরি মেদিনীপুর ক্যানেলের মুখে ১৮৯৬ সালে তৈরি লকগেট ও তাঁর সংলগ্ন এলাকা এখনও সদর ঘাট নামেই পরিচিত। অতীতের সেই সদরঘাট এলাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার। কাঁসাই নদীর দু’ধারে উর্বর পলিমাটি দিয়ে গঠিত কৃষি সমৃদ্ধ এই এলাকায় নৌকা, স্টিমার ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার সংযোজন হয় সড়ক ও রেলপথ।

পাঁশকুড়া স্টেশন তৈরি হয়েছিল প্রায় একশো বছর আগে। আজ যা জংশন স্টেশন। এই পথে যাতায়াত করেন ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারাও। পাঁশকুড়া থেকে তমলুক শহরগামী পাকা রাজ্য সড়কটিও বাংলার অন্যতম প্রাচীন সড়ক। এলাকাও জনবসতি পূর্ণ। রেল স্টেশন এলাকাতেই জেলার অন্যতম বৃহত্‌ সব্জি বাজার বসে। ফুল, বাদাম চাষের জেরে এলাকার অর্থনীতিও ভাল। বর্তমানে পাঁশকুড়া পুরাতন ও স্টেশন বাজার ঘিরে দ্রুত নগরায়ন চলছে। বাড়ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিবিধ পরিষেবার চাহিদা।

প্রায় দেড়শ বছর আগে এলাকার বাসিন্দাদের আধুনিক শিক্ষার জন্য ১৮৬৪ সালে পাঁশকুড়া সদর ঘাটের কাছে গড়ে উঠেছিল পাঁশকুড়া মিডল ইংলিশ স্কুল, পরে যার নাম হয় ব্রাডলি বারট হাইস্কুল। মুম্বইগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে এই স্কুলটি পাঁশকুড়ার অন্যতম প্রাচীন স্কুল। পরবর্তী সময়ে প্রতাপপুর হাইস্কুল, রঘুনাথবাড়ি, শ্যামসুন্দরপুর পাটনা হাইস্কুল, পাঁশকুড়া গার্লস হাইস্কুল গড়ে উঠেছে। রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬০ সালে গড়ে ওঠে বনমালী কলেজ।

এলাকার জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার রাস্তাঘাট, বিদ্যুত্‌, পানীয় জলের ব্যবস্থার কিছু সুরাহা হয়েছে। তবে আরও ভাল পাকা রাস্তা, উন্নত নিকাশি, পরিস্রুত পানীয় জল-সহ বিবিধ নাগরিক পরিষেবার দাবি ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ১৩ বছর আগে গড়ে ওঠা পাঁশকুড়া পৌরসভার কাছে বাসিন্দাদের প্রত্যাশাও অনেক। তা অজানা নয় পুরপ্রধানেরও। পুরপ্রধান জাকিউর রহমান খান বলেন, “পুর এলাকার প্রতি বাড়িতে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩৭ কোটি টাকার জল প্রকল্পের কাজ চলছে। সব রাস্তা পাকা করতে পুরসভা উদ্যোগী হয়েছে। এ ছাড়াও আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE