শালবনির গোবরু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারি। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
নিরাপত্তার দুই চিত্র!
একদিকে অবাধ ভোট লুটের অভিযোগ। অন্য দিকে, কড়া নিরাপত্তা বলয়।
মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের শালবনি, মেদিনীপুর সদরের অধিকাংশ বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মিলল। নিরাপত্তার কড়াকড়ি সেখানে এমনই যে, বুথ সহায়তা কেন্দ্রের কর্মীরাও বুথ চত্ত্বরে বসতে পারেননি। তারা বুথের বাইরে বসেই ভোটারদের সাহায্য করলেন। আর ভোটারদেরও বুথের গেটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে কার্ড দেখতে চাওয়া হল। তারপর মেটাল ডিটেকটর দিয়ে সারা শরীর পরীক্ষা!
অথচ, এ দিন আধা সামরিক বাহিনীর দেখা মেলেনি নারায়ণগড়, দাঁতন, কেশিয়াড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বুথে। ওই সমস্ত জায়গায় ব্যাপক রিগিং ও ছাপ্পার অভিযোগ তুলল বিরোধীরা। বামফ্রন্ট প্রার্থী প্রবোধ পণ্ডা বলেন, “বহু বুথে রিগিং ও ছাপ্পা হয়েছে। সমস্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করছি। ওই সমস্ত বুথে পুননির্বাচনের দাবি জানাব।” তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যা রায় অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, “সর্বত্রই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ভোট হয়েছে। মানুষ ভালভাবে ভোট দিয়েছেন। তবু কেউ কেউ এই ধরনের গপ্পসপ্প করছেন।”
শালবনি জঙ্গলমহল হওয়ায় সেখানে আধা সামরিক বাহিনী ছিলই। কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই ভোটও হয়েছে সেখানে। ফলে ওই সব এলাকায় বুথের ভেতরে বা কাছে কোনও দলের নেতানেত্রীদের দেখা মেলেনি। সকলেই সচিত্র পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আধা সামরিক বাহিনীর ঘনঘটা দেখা গিয়েছে মেদিনীপুর পুরসভা এলাকার বুথগুলিতেও। এমনকি শহর জুড়ে টহলও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান!
অথচ, নারায়ণগড়, দাঁতন, কেশিয়াড়ি-সহ যে সব এলাকার বুথ অতি সংবেদনশীল বলে প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল বাম, বিজেপি ও কংগ্রেস। সেই সমস্ত বুথের অধিকাংশতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকার সুযোগ নিয়ে তৃণমূল বুথ দখল করে ছাপ্পা দিয়েছে বলে অভিযোগ। বিজেপি প্রার্থী প্রভাকর তিওয়ারি থেকে বামফ্রন্ট প্রার্থী প্রবোধ পণ্ডা-সকলেই এক অভিযোগ করছেন। প্রবোধবাবু কিছু বুথে পুননির্বাচন চাইলেও প্রভাকর তিওয়ারি অবশ্য সে পথে হাঁটতে নারাজ। তাঁর কথায়, “পুননির্বাচন হলেও শাসক দল এভাবেই ভোট করাবে। ৯টি জায়গায় পোলিং এজেন্ট বসতে দেয়নি, একাধিক বুথে রিগিং হল, বারেবারে অভিযোগ জানিয়েছি, কী লাভ হল?” কংগ্রেস প্রার্থী বিমল রাজেরও অভিযোগ, “একাধিক জায়গায় বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। কমিশনকে জানিয়েও সুফল মেলেনি।” যদিও অভিযোগ খারিজ করে তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “এমন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন মানুষ আগে কখনও দেখেনি। রাজ্য সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আমাদের দলীয় কর্মীদের সংযম ও সহযোগিতার কারণেই তা হয়েছে।”
বেলদার গঙ্গাধর অ্যাকাডেমির বুথের নিরাপত্তার ভার সামলাচ্ছেন রাজ্য পুলিশ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
নারায়ণগড়ের খাকুড়দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে এ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি। সকাল থেকেই বুথের সামনে সিপিএম ও তৃণমূল কর্মীদের জটলা দেখা যায়। যদিও নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী ভোটগ্রহণ চলাকালীন ভোটকেন্দ্রের একশো মিটারের মধ্যে কোনও জমায়েত করা যায় না। এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ সিপিএম বিধায়ক সূর্যকান্ত মিশ্র ওই বুথে ভোট দিতে আসেন। সূর্যকান্তবাবু ভোট দিতে আসার কিছুক্ষণ আগে পুলিশ বুথের সামনে থেকে জটলা হটিয়ে দেয়। ভোট দিয়ে বেরিয়ে সূর্যকান্তবাবু বলেন, “সর্বত্র অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে না। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ায় শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। গড়বেতায় কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। আসানসোলের জামুরিয়া, খণ্ডঘোষ থেকে অশান্তির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।”
নারায়ণগড়ে বিভিন্ন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে নিরাপত্তা কর্মী বন্টনে বৈষম্যের ছবি ধরা পড়েছে। গড়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বুথে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জওয়ান। আবার ব্যাংদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’টি বুথ রয়েছে। কিন্তু সেখানেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জওয়ানকেই নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ কামিয়াচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বুথে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের চার জন কনস্টেবল।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমির তিনটি বুথে দেখা মিলল না কোনও কেন্দ্রীয় বাহিনীর। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল রাজ্য পুলিশের চার জন কনস্টেবল ও তিন জন হোমগার্ড। তবে মেদিনীপুর লোকসভার অন্তর্গত এগরায় কেন্দ্রীয় বাহিনী উপস্থিত ছিল। রাস্তাতেও চলছিল টহল। এলাকার কোনও বুথেই অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে এগরা-১ ও এগরা-২ ব্লকে ১৩টি বুথে এবং দাঁতন ও মোহনপুরের কয়েকটি বুথে বামেদের পোলিং এজেন্টকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
অবাধ ভোট হওয়া নিয়ে আগে থেকেই আশঙ্কা ছিলই। তাই সাত সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন বামফ্রন্ট প্রার্থী প্রবোধ পণ্ডা। মেদিনীপুর শহরের নির্মল হৃদয় আশ্রমের বুথে নিজের ভোট দিয়েই বেরিয়ে পড়েন। খড়্গপুর, নারায়ণগড়, দাঁতন, মোহনপুর-দ্রুত একের পর এক এলাকা চষে বেড়ান। ঘুরে বেড়ান বিজেপি প্রার্থী প্রভাকর তিওয়ারি, কংগ্রেস প্রার্থী বিমল রাজও। গলদঘর্ম হয়ে তাঁরা যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর রিগিংয়ের অভিযোগ করে চলেছেন তখন তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যা রায় সারাদিন বাড়িতে বসেই কাটালেন। অন্য দিন ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠলেও এ দিন একটু দেরি করেই ওঠেন। ক’দিনের পরিশ্রমের পর এ দিন একেবারেই বিশ্রাম। সকালে উঠে পুজো করে ব্রেকফাস্ট। তারপর বাড়িতে বসেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়া। নিজে প্রার্থী হয়ে বেরোবেন না? প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি তো তৈরি হয়েই বসে রয়েছি। ওঁরা (দলীয় নেতৃত্ব) বললেই যাব।” হয়তো আগে থেকেই জানতেন, এ দিন তাঁর বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন নেই। তবে এদিনই সন্ধ্যাদেবী মেদিনীপুর ছাড়ছেন না। আজ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার শিশির অধিকারীর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি কাঁথি যাবেন। সেখান থেকে কলকাতা।
ভোটে জিতলে প্রথমেই কী করবেন? জিতছেন ধরে নিয়েই সন্ধ্যাদেবী বলেন, “ওভাবে এখনও কিছু ভাবিনি। সব দিক দেখে, যেগুলো দ্রুত করা প্রয়োজন মনে হবে, সেগুলোই করব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy