Advertisement
E-Paper

চাকা গড়াতেই হুইস্কি আর মিক্সচারে বারের মৌতাত

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা কুড়ি। হাওড়া স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন মাঝবয়সী প্রবীর রায়। সময় খেয়াল হতেই দে ছুট। ধরবেন সাড়ে দশটার ব্যান্ডেল লোকাল। ট্রেন ছাড়তে দশ মিনিট বাকি। তবু এত তাড়াহুড়ো কেন?

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৬ ০২:৪১

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা কুড়ি।

হাওড়া স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন মাঝবয়সী প্রবীর রায়। সময় খেয়াল হতেই দে ছুট। ধরবেন সাড়ে দশটার ব্যান্ডেল লোকাল। ট্রেন ছাড়তে দশ মিনিট বাকি। তবু এত তাড়াহুড়ো কেন?

সহযাত্রী হিসেবে প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিতেই উত্তর এল চটপট, ‘‘জানলার ধারের সিটটা মিস হয়ে যাবে দাদা।’’ ওই ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা অবশ্য ভালই জানেন, জানলার ধারের মৌতাত। তবে প্রবীরবাবুর দৌড় কাজে এল না। ১০টা ২৫ মিনিট নাগাদ তিনি ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় উঠলেন বটে, কিন্তু সেখানে তখন জানলার ধারের একটি আসনও ফাঁকা নেই।

ট্রেন ছাড়তেই ওই কামরার বসার টানা লম্বা সিটটার জানলার দিকের মাঝবয়সী দুই যাত্রী নড়েচড়ে উঠলেন। ছোট্ট ঝুড়ি গামছা দিয়ে ঝুলিয়ে এক যুবকও প্রতিদিনের মতো হাজির ‘মিক্সচার’ নিয়ে। বাদাম, ঝুড়িভাজা, পেঁয়াজ, লঙ্কা আর টক একসঙ্গে মাখা। যা রেলযাত্রীদের কাছে ওই নামেই পরিচিত। গাড়ি গতি বাড়াতেই শুরু হয়ে গেল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাস খেলা। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই থাকে। আপাত ভাবে দেখলে মনে হয়, ওঁরা নিছকই অফিস যাত্রী। সারা দিনের ধকল কাটাতেই তাস খেলছেন। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগে না।

‘‘কী রে তপুদা? তোর ব্যাগ থেকে সবুজ বোতলটা বের কর না। ওই বোতলের ক্যাটক্যাটে সবুজ রংটা আমাদের কাজে আসে।’’ তাস হাতে বলে উঠলেন বছর ত্রিশের এক যুবক। এ বার সেই প্রবীরবাবু চারপাশ চেয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখে টেরিকটের প্যান্টের পকেট থেকে বের করলেন হুইস্কির একটি ছোট বোতল। দু’তিনটি হাত ঘুরে তাঁর কাছে এসে পৌঁছল একটি সবুজ রঙের অর্ধেক ভর্তি জলের বোতল। প্রবীরবাবুর মুখ গম্ভীর রেখেই পুরো হুইস্কি সেই বোতলের মধ্যে ঢাললেন। একজন বোতল থেকে আরও একটি জলের বোতল বের করলে প্রবীরবাবু বলে উঠলেন, ‘‘আর জল দিস না। জিনিসটা জোলো হয়ে যাবে।’’ শুনে পাশ থেকে ভেসে এল টিপ্পনী, ‘‘আরে প্রবীরদা, কাজল তো ভাঁটির ম্যানেজার। কার সঙ্গে কী মেশাতে হয় সেটা ও-ই ভাল বোঝে।’’

এরপর ওই বোতলে আরও জল মিশল। তারপর সেটি ঘুরতে লাগল তাস-খেলোয়াড়দের হাতে হাতে। সঙ্গে ‘মিক্সচারে’র টাকনা এবং সিগারেট। হাওড়া স্টেশনের নিত্যযাত্রীদের কাছে রেলের কামরাকে প্রায় বারের চেহারায় পৌঁছে দেওয়ার এই ছবিটা খুব চেনা। শুধু ভেন্ডার লাগোয়া কামরা নয়, অন্য কামরাতেও তিন-চার জনের দলে ভাগ হয়ে নানা অনুপান-সহ এই মদ্যপান এখন প্রায় প্রতিদিনের রেওয়াজ। নিত্যযাত্রীদের একাংশ জানান, আগে লোকাল ট্রেনে জলের বোতলে মিশিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে মদ খাওয়া চলত নিয়ম করে। কেউ কেউ আবার ভেন্ডার কামরায় জিনিসপত্রের ভিড়ে আড়াল খুঁজে নিতেন। কিন্তু এখন কোনও রাখঢাক নেই। শুধু ব্যান্ডেল লোকাল নয়, হাওড়া স্টেশন থেকে রাত সাড়ে ৯টার পরে ছাড়া কম-বেশি সব ট্রেনে নিয়ম করে এ সব চলে। হাওড়া স্টেশন চত্বরে, ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড লাগোয়া খাবারের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডের ছোট কাঠের গুমটিগুলি থেকেই মেলে নানা ব্র্যান্ডের মদের নানা মাপের বোতল। স্টেশনের স্টলগুলি থেকে অনেকে একটু বেশি ঠান্ডা জলের বোতল কেনেন। যাতে চলন্ত ট্রেনে ঠান্ডা জলের জোগান থাকে।

নিত্যযাত্রীদের অনেকেই ট্রেনের কামরায় এই ‘মজলিস’ বসানোর বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ, মদ্যপায়ীরা গলা চড়ান, গালিগালাজ শুরু করেন। প্রতিবাদ করলে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে অপমানিত হয়েছেন। লোকালের মহিলা-কামরায় শুধু রেল পুলিশ থাকে। অন্য কামরাগুলিতে তাই মদের আসর চলে বিনা বাধায়। রেল পুলিশকে জানিয়েও কোনও লাভ হয় না।

তাই হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়া রাতের লোকাল ট্রেনগুলিতে প্রবীরবাবুদের দাপট কমে না। (চলবে)

train miscreants
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy