অবশেষে পরিবারের সঙ্গে। বারাসতের হোমে, মঙ্গলবার। — সুদীপ ঘোষ
টুকরো টুকরো কিছু কথা। গুনে-গেঁথে-জুড়ে সেগুলো দিয়েই বুনে দেওয়া গেল গল্পের শেষটুকু!
আর তাই কেউ ২৯ বছর পরে বৃদ্ধা মা ফিরে পেলেন হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে। কেউ বা প্রায় ন’বছর পরে বাড়ির পথ ধরতে পারল। আর তাদের দেখেই বাড়ি ফেরার স্বপ্নটা নতুন করে চারিয়ে গেল আরও কয়েক জনের মধ্যে।
টানা ৪৫ দিনের যুদ্ধ শেষে এই অসাধ্য সাধনটাই করে ফেলতে পেরেছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আর তাদেরই উদ্যোগে মঙ্গলবার বারাসতের সরকারি হোম ‘কিশলয়’-এ এসে এমন ১৮ জনকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন ভিন্ রাজ্য থেকে আসা পরিবারের লোকেরা। কান্নায় ভেঙে পড়ল দু’পক্ষই। যা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না হোম ও শিশু সুরক্ষা কমিটির আধিকারিকেরাও।
৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া অথবা কোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু, কিশোরদের রাখা হয় এই কিশলয় হোমে। এই ১৮ জনের প্রত্যেকেই ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউই বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা ঠিকঠাক বলতে পারেননি। ‘বাড়ির পাশে রেললাইন আছে’র মতো ভাঙাচোরা কিছু তথ্য ছাড়া। এমন বেশ কয়েক জনের দেওয়া সেইটুকু বিক্ষিপ্ত সূত্র, কথা বলার ধরনের উপর ভর করেই লাগাতার ৪৫ দিন ক্যাম্প করে, খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সাথী’র ইতিকণা পাল, অরবিন্দকুমার, খোকন বৈদ্য, আমন সাউ-রা। তিরিশ বছরের কম বয়সী ওই তরুণ-তরুণীদের দলটা তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চিরুনিতল্লাশি চালিয়েছেন। হাল না ছেড়ে খুঁজে এনেছেন ওই আঠেরো জনের বাবা-মাকে। এ দিন বাবা-মায়েদের হাতে ওই আবাসিকদের তুলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগনার শিশুসুরক্ষা কমিটির চেয়ারপার্সন অরবিন্দ দাশগুপ্তরাও তাই সোজাসুজিই বলছেন, ‘‘এ সত্যিই অসাধ্য সাধন!’’
২৯ বছর পর ঝাড়খণ্ডের সাইমন হাঁসদাকে ফিরে পেয়ে এ দিন অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন বৃদ্ধ বাবা-মা। কারণ, সাইমনের বয়স এখন ৩৪। পাঁচ বছর বয়সে সে যখন হারিয়ে গিয়েছিল, তখন সাইমনের বাবার বয়সও ছিল প্রায় ৩৪। সেই সময়কার ‘স্বামীর মতো’ দেখতে সাইমনকে দেখেও তাই
চিনতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি মায়ের। বাকিটুকু মিলিয়ে দিয়েছে তিন জনের চোখের জল।
শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্য দোলা দে মিত্র জানান, পাঁচ বছর বয়েসেই হোমে আসে সাইমন। ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা শিশুটির কথাবার্তা কেউই বুঝতে পারতেন না। পুলিশের খাতা, হোমের রেজিস্টারে লেখা হয়, বাড়ি সম্ভবত দুর্গাপুরে। কিন্তু দুর্গাপুরে পরিবারের হদিস না মেলায় হোমেই থেকে যায় সাইমন। কিন্তু ১৮ বছর বয়সের বেশি ছেলেদের থাকার হোমে রাখার নিয়ম নেই। এ দিকে, বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। সাইমনকে তাই রান্নাবান্নার প্রশিক্ষণ দিয়ে হোমেই কাজে নিযুক্ত করা হয়।
কিশলয় হোমের সুপার মলয় চট্টোপাধ্যায় জানান, সাইমনের মতো যাদের বছরের পর পর বছর ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি, কিংবা যাদের পরিবার নিতে চায়নি— তেমন কয়েক জনকে নিয়ে ৪৫ দিনের এই ক্যাম্প শুরু হয়। সেখানেই সাইমনের দেহাতি চেহারায় অন্য গন্ধ পান সংস্থার সদস্যরা। হোমের তথ্য ঘেঁটে পাঁচ বছর বয়সের সাইমনের ছবি দেখে সন্দেহ বাড়ে। সাইমনের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা চালিয়ে, ঝাড়খণ্ডের সমস্ত থানায় তাঁর পুরনো ছবি ও তথ্য পাঠিয়ে চলতে থাকে খোঁজখবর।
দুবরাজপুর নামটি দুর্গাপুরের কাছাকাছি হওয়ায় ওই থানায় গিয়ে অনুসন্ধানকারীরা জানতে পারেন, ২৯ বছর আগে সেখানকার একটি ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল। এফআইআরও রয়েছে। থানা থেকে পরিবারের ঠিকানা নিয়ে পুরনো ছবি-সহ সমস্ত তথ্য জানানো হয় তার বাবা-মাকে। এর পরে ঝাড়খণ্ডের শিশু সুরক্ষা কমিটির সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদান এবং সমস্ত কিছু যাচাই করে এ দিন বাবা-মাকে ফিরে পেয়েছেন ৩৪ বছরের সাইমন। ২৯ বছর পরে!
আত্মীয়দের সঙ্গে ট্রেনে হাওড়ায় এসে হারিয়ে গিয়েছিল ৬ বছরের ছেলে। তার সঙ্গেও দিনের পর দিন কথা বলে, বাড়ি থেকে ট্রেনে উঠে ক’দিন সে ট্রেনে ছিল, তা যাচাই করে গুগ্ল ম্যাপের সাহায্যে অসমের ধুপগুড়ি থেকে ঢুঁড়ে আনা হয়েছে বাবা-মাকে। ৯ বছর পরে ফিরছে সেই ছেলে। আর এক জনের গান শুনে বিহারের প্রতিটি থানায় ছেলেটির ছবি-তথ্য পাঠিয়ে সেখানে গিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েতে কথা বলে খোঁজ মিলেছে তার পরিবারেরও।
মানসিক প্রতিবন্ধী আট বছরের একটি ছেলে বছর দুয়েক আগে হোমে এসে আউশগ্রাম ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি। আউশগ্রামে কারও খোঁজও মেলেনি। শেষমেশ সেখানকার কোন কোন বাসিন্দা গত দু’ বছরে অন্যত্র চলে গিয়েছেন, তা খোঁজ করে বেলঘরিয়া থেকে খোঁজ মিলেছে বাবা-মায়ের।
কিন্তু পরিবার পেলেই তো হল না, রয়েছে অনেক নিয়মকানুন। সব নিয়ম মেনে যাবতীয় তথ্য ভালমতো যাচাই করে সোমবার ডেকে আনা হয়েছিল আঠেরো জনের বাবা-মাকে। এর পরে এ দিন অনুষ্ঠান করে কাগজপত্র সমেত হারানো ছেলেদের তুলে দেওয়া হয়েছে বাবা-মায়ের হাতে।
অনুষ্ঠান ভেসে গিয়েছে আবেগ আর কান্নায়। শিশু সুরক্ষা কমিটির বারাসতের কর্মী দোলাদেবীর কথায়, ‘‘এরা হয়তো কেউ কোনও দিন বাড়ি ফিরতে পারত না। হোমেই পড়ে থাকত। চেষ্টা থাকলে অসম্ভব বলে যে কিছু নেই, এটা তারই দৃষ্টান্ত।’’
‘অসম্ভব’ সম্ভব হয়েছে যাঁদের হাতে, সেই ছেলেমেয়ের দল অবশ্য এ দিন চুপচাপ কাজটাই করে গিয়েছে। জলভরা চোখে, হাত জোড় করে তাঁদের নমস্কার জানিয়েছেন বাবা-মায়েরা। আর হোমে থেকে যাওয়া অন্য আবাসিকেরা আব্দার করেছে, ‘‘আমার বাবা-মাকেও খুঁজে দাও!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy