এ বার কি যাত্রা শুরু আরও বড় কোনও লক্ষ্যের দিকে? ছবি: পিটিআই।
মাস দু’য়েক আগেই বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এসেছেন। নিজের দুর্গ আপাতত ‘দুর্জয়’। তৃণমূল নেতারা অন্তত তাই মনে করছেন। পাঁচ বছর রাজ্যের মসনদে কাটানোর পর পায়ের তলার জমিটা যখন আরও শক্ত মনে হচ্ছে, তখন কি জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার কথা ভাবছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সরাসরি বলেননি সে কথা। কিন্তু শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকে এ দিন যে আভাস দিয়েছেন, তাতে বেশ স্পষ্ট যে ২০১৯-ই এখন পাখির চোখ মমতার। ত্রিপুরাতেও ক্ষমতায় আসছে তৃণমূল, আত্মবিশ্বাসী দাবি নেত্রীর।
জাতীয় রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান দখল করাই যে আপাতত তৃণমূলের সামনে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য, তা বেশ স্পষ্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ দিনের ভাষণে। কী বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বললেন, ‘‘অনেকে বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কিন্তু আমি তা চাই না। আমি চাই কুঁড়েঘরেই থাকতে। ছোট্ট ঘরে থাকতেই আমার ভাল লাগে। আমরা বন্ধু এবং সহযোগী দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাব। তাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করব। আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী হোক আমি চাই। তাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আরও মজবুত হবে।’’ কেন্দ্রীয় সরকার এখন রাজ্য সরকারের কাজে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করছেন বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, সব ব্যাপারে কেন্দ্র আজকাল নাক গলাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে সমস্ত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।’’
জাতীয় রাজনীতিতে এ বার বড় জায়গা পাওয়ার লক্ষ্যে যে তৃণমূল ঝাঁপাবে, এ দিন সেই আভাসটা প্রথম বার দিলেন কিন্তু মুকুল রায়। শহিদ স্মরণের মঞ্চে নিজের বক্তৃতা এ দিন সংক্ষিপ্তই রেখেছেন মুকুল। কিন্তু আজকাল মূলত তৃণমূলের অন্যতম ‘দিল্লি ম্যানেজার’ হিসেবে ব্যস্ত থাকা এই নেতা রাজধানীর অলিন্দে তৃণমূলের আশু লক্ষ্য সম্পর্কে যথেষ্ট আভাস দিয়ে দেন নিজের সংক্ষিপ্ত ভাষণেই। মুকুল রায়ের কথায়, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সরকারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে তৃণমূল। সেই লক্ষ্যেই দল এগোচ্ছে।
মুকুল রায়ের পর তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই আভাস দেন। তিনিও দাবি করেন, লোকসভা এবং রাজ্যসভায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে দল। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও বেশি আসনে জয় পাওয়াই যে লক্ষ্য, সুদীপ এ দিন তা-ও বলেন।
জাতীয় রাজনীতিতে দলের দুই স্তম্ভ যা বললেন, তা যে তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা নয়, সে কথা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে। লোকসভা নির্বাচন এখনও অনেক দূরে। জাতীয় রাজনীতির কোনও বিষয় নিয়ে খুব তোলপাড় চলছে বা তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির সঙ্ঘাত চরমে পৌঁছেছে তেমনও নয়। তবু কেন্দ্রীয় সরকারকে এ দিন তীব্র আক্রমণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিচ্ছে না বলে যে অভিযোগ তিনি আগেও একাধিক বার করেছেন, সে কথা এ দিন আরও জোর দিয়ে বলেছেন। রাজ্যের মাথায় যে দেনার বোঝা, তা শোধ করতেই বর্তমান অর্থবর্ষে ৪৭ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু দেনার প্রসঙ্গ উঠলেই মমতা যে ভাবে বামেদের দায়ী করতেন, বৃহস্পতিবার তা না করে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উপরই অনেকটা দায় চাপিয়ে দিলেন। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের মাথায়ও যে বিপুল দেনার বোঝা রয়েছে, সে কথা টেনে আনলেন। তার পর বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের ভুল অর্থনীতির কারণে দেনা করে করে অনেক রাজ্য আজ মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়েছে।’’ সর্বশিক্ষা অভিযান, পুলিশের আধুনিকীকরণ-সহ বিভিন্ন খাতে কেন্দ্র টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দাবি। গ্রামীণ সড়ক যোজনায় রাস্তা নির্মাণের জন্যও নাকি কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। মমতা এ দিন অন্তত সে রকম দাবিই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনাকে কটাক্ষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, ওই প্রকল্পের নামে নরেন্দ্র মোদী ‘ভাঁওতা’ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য যে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, তার সঙ্গে ওই প্রকল্পটাকে জুড়ে দিল। দিয়ে বলল কেন্দ্র সব করে দিয়েছে। অথচ করলাম আমরা রাজ্য সরকার। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জন্য অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিলাম আমি। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বলল জনধন যোজনা!’’ কেন্দ্রের ব্যর্থতায় পশ্চিমবঙ্গের এক কোটি মানুষের আধার কার্ড হয়নি বলেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন অভিযোগ করেছেন। আধার কার্ড না থাকলে পেনশন, স্কলারশিপ, সরকারি ভর্তুকি, এলপিজি-সহ নানান সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে কেন্দ্র যে নীতি নেওয়ার কথা বলছে, তারও তীব্র সমালোচনা করেন মমতা। মোদী সরকারকে কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘টাকা দেওয়ার বেলায় খোঁজ নেই, কিল মারার গোঁসাই!’’
আরও পড়ুন: ২১ জুলাইয়ে মঞ্চ থেকে রাজপথ, নানা রঙের মুহূর্ত
শহিদ স্মরণের সমাবেশ থেকে তৃণমূল নেত্রীর এই ভাষণ শোনার পর বাংলার রাজনৈতিক শিবির বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন বাংলা দখলে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে। চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রক হতে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাতে এনডিএ-র শরিকরাও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো জায়গায় নেই। এনডিএ-র বাইরে থাকা আঞ্চলিক দলগুলির অবস্থা আরও কঠিন। তৃণমূল যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে সেখান থেকে কিছু আদায় করে আনতে মমতা পারছেন না। সেই কারণেই মমতা চাইছেন আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী হোক। মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, মমতা চাইছেন বিজেপি এবং কংগ্রেসের মতো বড় দলকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে সরকার হোক। তৃণমূল সেই সরকারের চালিকাশক্তি হয়ে উঠুক।
সিবিআই, ইডি, আয়কর দফতরের সক্রিয়তা নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘সব রাজ্যের উপর দেনা চাপিয়ে দিয়ে শুধু নোট ছাপাচ্ছে আর সিবিআই লাগাচ্ছে। শুধু নোট ছাপাচ্ছে আর ইডি লাগাচ্ছে।’’ এজেন্সি লাগিয়ে কেন্দ্র যে ‘অত্যাচার’ চালাচ্ছে, তার জেরে ৮০ হাজার শিল্পপতি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন বলেও মমতার দাবি। তাঁর কটাক্ষ, কালো টাকা দেশে ফেরেনি, সাদা টাকা দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তৃণমূলকে ছড়িয়ে দিতে যে এ বার তিনি অনেক বেশি উৎসাহী, তা-ও মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ত্রিপুরায় কংগ্রেস পরিষদীয় দল ভেঙে দিয়ে সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিরোধী দলনেতা সুদীপ রায়বর্মনকে এ দিনের মঞ্চে ভাষণ দিতে দেখা গিয়েছে। মমতা নিজের ভাষণেও বলেছেন, ‘‘আগামী নির্বাচনে ত্রিপুরাতেও আমাদের সরকার হবে।’’ তিনি নিজেও ত্রিপুরা যাবেন বলে শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকেই ঘোষণা করে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy