কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের কাজকর্ম নিয়ে ওঠা নানা অভিযোগের জবাবদিহি চাইলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পরই এই দুই বন্দরের কাজকর্ম নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে সিবিআই ও জাহাজ মন্ত্রকের ভিজিল্যান্স শাখা।
বন্দরের পণ্য খালাসের একচেটিয়া কারবারে অনিয়ম এবং অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। পরিস্থিতি জানতে জাহাজ মন্ত্রকের কাছে ১১ দফা প্রশ্ন পাঠিয়ে জরুরি ভিত্তিতে জবাব চেয়েছেন মোদী। এর পরই কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের পণ্য খালাস সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন জাহাজ মন্ত্রকের ভিজিল্যান্স শাখার কর্তা অধীর কুমার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিবিআই-ও এই সংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখছে। দুর্নীতির গন্ধ পেলে তারা মামলা করবে বলে জানিয়েছে।
তবে পণ্য খালাস নিয়ে অনিয়মের কথা মানতে চাননি কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালো।ঁ তাঁর কথায়, “লাইসেন্স প্রথা মেনে হলদিয়া ও কলকাতায় পণ্য খালাস হয়। এর মধ্যে অনিয়ম কিছু নেই।” চেয়ারম্যান বলেন, জাহাজ মন্ত্রকের নীতি মেনে বহু দিন ধরেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে।
কিন্তু সেই লাইসেন্স প্রথাটা কেমন? বন্দর সূত্রের খবর, ১৯৬৩ সালের মেজর পোর্ট ট্রাস্ট আইনের ৪২ নম্বর ধারায় বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ ফি-এর বিনিময়ে কোনও সংস্থাকে পণ্য খালাসের লাইসেন্স দিতে পারে। কিন্তু সেই লাইসেন্স দেওয়ার আগে স্বচ্ছ ভাবে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন করতে হয়। চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়ার আগে জাহাজ মন্ত্রকের অনুমতি নেওয়াটাও বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি মন্ত্রক পণ্য খালাসের যে দর নির্দিষ্ট করে দেয়, সেই দরেই পণ্য খালাস করার কথা লাইসেন্স পাওয়া সংস্থার।
বন্দরের একাংশের অভিযোগ, কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে এর কোনটিই করা হয় না। পুরো কারবার নিয়ন্ত্রণ করে দু’একটি সুবিধাভোগী সংস্থা। সেই সংস্থা যেমন সামান্য টাকা জমা দিয়ে বার্ষিক লাইসেন্স সংগ্রহ করে, আবার পণ্য খালাসের জন্য নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি টাকাও আদায় করে।
বন্দর-কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, আইন মেনে বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্র চেয়ে বা নিলামের মাধ্যমে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন করতে পারে। স্বচ্ছ ভাবে এই কাজ হলে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতায় পণ্য খালাসের দর যেমন কমবে, তেমনই নিলামের জেরে বন্দরের রোজগার বাড়বে। কিন্তু হলদিয়া ও কলকাতা বন্দরে তা করা হয় না।
জাহাজ মন্ত্রক সূত্রের খবর, হলদিয়া বন্দরের ১২টি বার্থের মধ্যে ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে দরপত্র চেয়ে এবিজি-এলডিএ নামে এক সংস্থাকে নির্বাচন করে যন্ত্রনির্ভর পণ্য খালাসের বরাত দেন কর্তৃপক্ষ। তাতে শুধু এই দু’টি বার্থ থেকেই বন্দরের প্রায় বছরে ১০০ কোটি টাকা আয় হচ্ছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা পছন্দ হয়নি দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলির। রাতদুপুরে এবিজির এক কর্তার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে অপহরণ করেছিল দুষ্কৃতীরা। এই ঘটনার পিছনে প্রতিযোগী সংস্থার ভূমিকা থাকার অভিযোগ উঠেছিল তখনই। হলদিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এবিজি-ও অভিযোগ করেছিল, অন্য সংস্থাগুলির গা-জোয়ারির কারণেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও সেই সব খবর পৌঁছেছে।
গুজরাতের এক বিজেপি সাংসদও প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করেছিলেন। বন্দর সূত্রে খবর, তার পরেই জাহাজ মন্ত্রকের ভিজিল্যান্স শাখা মারফত কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের কাছে এই সংক্রান্ত সব তথ্য চাওয়া হয়েছে। চিঠি গিয়েছে আরও ১২টি বন্দরের চেয়ারম্যানের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সিবিআই-কেও কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর থেকে পণ্য খালাস সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সিবিআইয়ের একটি দল হলদিয়ায় গিয়ে এই কাজ করে। তাদের এক কর্তা বলেন, “পিএমও-র নির্দেশ পেয়েই আমরা ওই দুই বন্দরে পণ্য খালাস সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করা শুরু করেছি। দুর্নীতির সূত্র মিললে মামলা হবে।”
জাহাজ মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে কোন কোন পণ্য খালাসকারী সংস্থা রয়েছে, তাদের কী ভাবে, কত দিনের জন্য, কী শর্তে, কত টাকা ফি নিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কী ভাবে বছরের পর বছর এই লাইসেন্স নবীকরণ করা হচ্ছে, না হয়ে থাকলে কী ভাবে তারা পণ্য খালাস করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এসেছে কি না, এলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, গত কয়েক বছরে নতুন কোনও সংস্থাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে কি না, হলে কী ভাবে দেওয়া হয়েছে এ সব নিয়েও সবিস্তার তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে।
কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে সব তথ্য তাঁরা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, হলদিয়া বন্দরের ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে যন্ত্রনির্ভর পণ্য খালাস নিয়ে বিবাদের সময় থেকেই দরপত্র ডেকে সংস্থা নিয়োগের কথা উঠেছে। পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলির কাছ থেকে কী ভাবে রয়্যালটি আদায় করা হবে, নিলাম করে সংস্থা নির্বাচনের পদ্ধতিই বা কেমন হবে, তা নিয়ে মন্ত্রক একটি বিশেষ কমিটি গড়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্ট এখনও জমা পড়েনি। তাই পুরনো প্রথা মেনেই পণ্য খালাসকারী সংস্থাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy