Advertisement
০১ মে ২০২৪
ঘুরপথে হাজির সৌরভের বাড়ি

মদতদাতারা কবে ধরা পড়বে, প্রশ্ন মুকুলকে

বেলা তখন সাড়ে তিনটে। বামনগাছিতে নিহত ছাত্র সৌরভ চৌধুরীর বাড়ির সামনে ঝান্ডা হাতে জড়ো হয়েছিলেন তৃণমূলের মহিলা কর্মীদের একাংশ। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই তাঁদের পথ আটকে দিচ্ছিলেন প্রতিবাদী মঞ্চের মহিলারা। হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়াল তিনটি মোটরবাইক।

সৌরভের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সভায় যাওয়ার পথে মুকুল রায়।  —নিজস্ব চিত্র।

সৌরভের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সভায় যাওয়ার পথে মুকুল রায়। —নিজস্ব চিত্র।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

বেলা তখন সাড়ে তিনটে। বামনগাছিতে নিহত ছাত্র সৌরভ চৌধুরীর বাড়ির সামনে ঝান্ডা হাতে জড়ো হয়েছিলেন তৃণমূলের মহিলা কর্মীদের একাংশ। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই তাঁদের পথ আটকে দিচ্ছিলেন প্রতিবাদী মঞ্চের মহিলারা।

হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়াল তিনটি মোটরবাইক। একটি বাইকের পিছন থেকে নেমে এলেন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক জন। মুখ-ঢাকা হেলমেট খুলতেই বোঝা গেল, তিনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়! প্রতিবাদীরা আটকানোর আগেই ভিতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। সৌরভের বাবা সরোজ চৌধুরী ও দাদা সন্দীপ-সহ কয়েক জনকে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সৌরভ খুন হওয়ার সাত দিনের মাথায় এই ভাবেই শাসক দলের পা পড়ল নিহতের বাড়িতে। মুকুল এলেন। দেখলেনও। তবে পুরোপুরি জয় করতে পারলেন কি না, সে প্রশ্নটা থেকেই গেল। কারণ, সৌরভের পরিবার এবং প্রতিবেশীরা তাঁকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, দোষীদের নেপথ্য মদতদাতাদের কবে ধরা হবে? বামনগাছি থেকে সমাজবিরোধীদের দাপট কমবে কবে? মুকুল আশ্বাস দিলেন। কথা দিলেন সৌরভের মৃত্যু নিয়ে কোনও রাজনীতি হবে না। কিন্তু সভামঞ্চে অন্য নেতা-মন্ত্রীরা সৌরভকে টিএমসিপি-র সদস্য বলে প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েই গেলেন। ফলে মুকুলবাবুর ‘মিশন’ পুরোটা সফল হতে পারল না।

সৌরভের বাবা ও অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন মুকুল রায়। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

এ দিনই সৌরভের বাড়ি থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে সভা ডেকেছিল তৃণমূল। সৌরভকে নিয়েই সভা, অথচ এর মধ্যে সৌরভের বাড়িতে যাননি দলের কেউ এ নিয়ে একটা অস্বস্তির কাঁটা ছিলই। অন্য দিকে অভিযুক্তদের পিছনে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মদত আছে বলে এলাকার বাসিন্দাদের দাবি। সেই ক্ষোভের জেরে প্রথম থেকেই তাঁরা বলে আসছিলেন, তৃণমূল নেতৃত্বকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। সব মিলিয়ে একটা দমচাপা আবহ তৈরি হয়েছিল। সেটাই খানিকটা সহজ করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এ দিন সৌরভের বাড়িতে যান মুকুল।

যদিও বিক্ষোভের মুখে পড়ার ভয়টা ছিলই। সেই কারণে গাড়ি থেকে নেমে বাইকে চেপে অনেকটা ঘুরপথে সৌরভের বাড়ি পৌঁছন মুকুল। খানিকটা চুপিসারে, খানিকটা হঠাৎ করে হাজির হওয়াটাই ছিল উদ্দেশ্য। তৃণমূল সূত্রের খবর, মুকুলবাবু মধ্যমগ্রাম পৌঁছতেই তাঁর কনভয়ে সঙ্গী হন মধ্যমগ্রামের বিধায়ক রথীন ঘোষ। বারাসত থেকে যোগ দেন তৃণমূল নেতা অশনি মুখোপাধ্যায় এবং আরও দু’জন। বামনগাছি চৌমাথা থেকে প্রায় ৫০০ মিটার আগে একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে হঠাৎই থেমে যায় মুকুলবাবুর সাদা স্করপিও। অশনিবাবুর মোটরবাইকের পিছনে সওয়ার হন মুকুল। মাথায় পরে নেন কালো মুখ ঢাকা হেলমেট। তার পর বামুনপাড়ার ভিতর দিয়ে স্টেশন রোড হয়ে ঘুরপথ ধরেন তিনি।

যত কাণ্ড তারাপীঠে।
সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

হঠাৎ এমন পথ বদলে কিছুটা হতচকিত হয়েছিল পুলিশও। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বিক্ষোভ হতে পারে আঁচ করে সৌরভের বাড়ির সামনে গিয়েছিলেন দত্তপুকুর থানার আইসি সঞ্জয় চক্রবর্তী। হঠাৎই তিনি দেখেন, মোটরবাইক থেকে মুকুলবাবু নামছেন!

এলাকাবাসীদের একাংশের মতে, বিরাট গাড়ি নিয়ে কিংবা সভাস্থল থেকে সরাসরি সৌরভের বাড়িতে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। পরিস্থিতি আগাম আঁচ করেই নতুন পথ বেছেছিলেন মুকুল। তিনি নিজে অবশ্য দাবি করছেন, “এ রাস্তায় গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হতো বলেই মোটরবাইকে এসেছিলাম।”

এত দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কিছু নেতা-কর্মী ছাড়া দলের নেতা-মন্ত্রী এমনকী স্থানীয় স্তরের কোনও নেতাকেও সৌরভের বাড়ি যেতে দেখা যায়নি। তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, সৌরভের পরিবার যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের সমালোচনা করছেন তাতে তাঁরা ব্যথিত। তাই তাঁরা যাচ্ছেন না। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ঘটনার সাত দিন পর এই প্রথম শাসক দলের প্রতিনিধি সৌরভের বাড়ি গেলেন।

এ দিন সকালে অবশ্য দলীয় সভায় সৌরভের পরিবারকে আমন্ত্রণজানাতে গিয়েছিলেন ছোট জাগুলিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান নুরুল হক ও তৃণমূল নেতা অশনি মুখোপাধ্যায়। আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয় সৌরভের পরিবার। বাড়ির চারপাশ কার্যত ঘিরে রেখেছিলেন সৌরভের বন্ধুরা। দুপুর গড়াতেই রাস্তার ধারে বসে পড়েন এলাকার মহিলাদের একটা বড় অংশও। বাড়ির সামনে অপরিচিত মুখ ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইছিলেন তাঁরা।

এতদসত্ত্বেও কেন এ ভাবে ঝুঁকি নিয়ে সৌরভের বাড়ি গেলেন মুকুলবাবু?

তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন, বছর খানেক আগে কামদুনির ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ার পরেও তাঁর সঙ্গে বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন গ্রামের মহিলারা। তৃণমূলের একাংশই বলছেন, কামদুনির ভুল বামনগাছিতে আর করতে চাননি মুকুলবাবুরা। পরিস্থিতি যাতে আরও বিগড়ে না যায়, সে জন্যই অন্য কারও উপরে ভরসা না রেখে নিজেই এ দিন সৌরভের বাড়ি চলে যান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

কিন্তু সৌরভের বন্ধু-পরিজনরা গোড়া থেকেই বলে এসেছেন, এই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি চান না তাঁরা। এ দিন মুকুলবাবুকেও তাঁরা সেটাই জানিয়েছেন। মুকুলবাবু অবশ্য সৌরভের বাড়িতে গিয়ে রাজনীতির কথা তোলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু সৌরভের পরিবার বারবারই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে, দোষীদের মদতদাতা যারা, তাদের কবে ধরা হবে? মুকুলবাবু বলেন, “সবই করা হবে। তার পরেই আমরা আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।”

ঘটনা হল, এ দিন তৃণমূলের সভায় বলতে উঠে মুকুলবাবু নিজে রাজনীতির প্রসঙ্গ তোলেননি। পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুও রাজনীতির কথা বলেননি। সৌরভ খুনে প্রধান অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকারকে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে যাঁর বিরুদ্ধে, সেই তৃণমূল নেতা তুষার ওরফে বিশু মজুমদারকে সভাস্থলে দেখা গেলেও তাঁকে মঞ্চে তোলা হয়নি। কিন্তু মুকুলবাবুর প্রয়াস দুর্বল করে দিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মীদের সঙ্গে সৌরভের ছবি দেখিয়ে অন্য বক্তারা দাবি করলেন, সৌরভ তাঁদের দলেরই সদস্য। বারবার বলে গেলেন, এই খুনের পিছনে রয়েছে সিপিএম-বিজেপি’র মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরাই। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রইলেন এ সবের পুরোভাগে।

যা শুনে সৌরভের পরিবারকে ফের বলতে হল, “এ সব মিথ্যা। সৌরভের সঙ্গে সব দলেরই ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ও কোনও রাজনীতি করত না।” দিনের শেষে এলাকাবাসীও ফের দেখলেন, রাজনীতি করব না বলেও শেষ পর্যন্ত রাজনীতিই করে গেলেন তৃণমূল নেতারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE