প্রতীক্ষায়—ফাইল চিত্র
জাকজমক করে দিদির হাতে উদ্বোধনের পরেও চাষিদের একটা বড় অংশকেই কিসান মান্ডি মুখো করতে ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে কৃষি বিপণন দফতর। রাজ্যের বিড়ম্বনা কয়েক গুন বাড়িয়ে এ বার মান্ডির ঘর-বিলি প্রক্রিয়া থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
বুধবার দুপুরে রামপুরহাট ১ ব্লকের ঘটনা। যেখানে এ দিন মান্ডির ঘরবিলির জন্য রীতিমতো তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। কিন্তু, আবেদনকারীদের উপস্থিতির শোচনীয় হার দেখে প্রশাসনকে শীঘ্রই বন্ধ করে দিতে গোটা প্রক্রিয়াটিই। এমনকী, হাজির থাকার কথা থাকলেও এলেন না প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ বছরখানেক আগেই উদ্বোধন হওয়া ওই মান্ডির ১৭টি ঘরের জন্য আবেদন করেছিলেন ১৪৫ জন। কিন্তু এ দিন লটারির সময়ে মাত্র ১৫ জন আগ্রহী চাষি হাজির হন। অভিযোগ, দু’ এক দিন বসলেও ওই মান্ডিতে এখন আর বাজার বসে না। ঘরগুলি বন্ধ হয়েই পড়ে রয়েছে। কার্যত জনমানবশূন্য হয়েই পড়ে রয়েছে তা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া মান্ডির এই করুণ দশা দেখেই সবাই পিছিয়ে আসছেন বলেই কৃষি বিপণন বিশ্লেষকদের মত। বেগতিক পরিস্থিতি দেখে বাধ্য হয়ে ফের নতুন করে ডাকযোগে আবেদনকারীদের চিঠি পাঠিয়ে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্লক প্রশাসন।
এ দিকে, রাজ্যে যে ১৭১টি কিসান মান্ডি নির্মাণ শেষ হয়েছে, তার অধিকাংশই তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে বলে অভিযোগ। মাত্র কয়েকটিতেই শিবির করে ধান কেনা হচ্ছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রতি ব্লকে এই ধরনের মান্ডি তৈরি হলে চাষি সেখানে নিজেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারবেন। ফড়ের হাত এড়িয়ে সরাসরি খদ্দের পাবেন। ফলে অভাবী বিক্রি করে লোকসান করতে হবে না। খোলাবাজারে যখন ধান, সব্জির চড়া দাম, তখনও সামান্য টাকায় ফড়ের কাছে তা বেচে মাথা চাপড়াচ্ছেন চাষি— এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে বলেই দাবি ছিল তৃণমূল সরকারের।
রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা ছিল, মান্ডির দোকান ঘর বিলি করা হবে টেন্ডারের মাধ্যমে। যে কেউ সরকারি টেন্ডারে যোগ দিতে পারবেন। প্রতি মান্ডিতে গড়ে ২২টি দোকানঘর, আর চাতালে প্রায় ৩০০ চাষির বসার ব্যবস্থা থাকবে। মান্ডিতে চাষিরা সারা বছর ধান বিক্রি করতে পারবেন। প্রতি মান্ডিতে একজন ‘প্রোকিওরমেন্ট অফিসার’ নিয়োগ করা হবে। মান্ডিতেই থাকবে হিমঘর। বিক্রি না-হওয়া সব্জি ফিরিয়ে নিয়ে না গিয়ে সামান্য খরচে হিমঘরে রাখতে পারবেন চাষি। সেই মতো প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছে এক একটি কিসান মান্ডি। কিন্তু কাজের বেলা দেখা যাচ্ছে, হিসেব মিলছে না। গুটিকতক ব্যতিক্রম ছাড়া, উদ্বোধন হওয়ার পরেও ‘চালু’ হচ্ছে না মান্ডিগুলো। প্রাক্তন কৃষি অধিকর্তা শ্যামল মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘প্রকল্পের ভাবনা ঠিকই ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে উপযুক্ত রূপরেখা দরকার, তার অভাব রয়েছে। আসলে চাষিরা সম সময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন। মান্ডি নিয়ে তাঁদের এই অনিশ্চয়তা দূর করা দরকার।’’
কেন এ দিন যোগ দিলেন না আবেদনকারীরা?
জেলার ১৩টি মান্ডিই উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু কাল আগে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের পর্যবেক্ষণই হচ্ছে, গুটিকয়েক মান্ডি আংশিক ভাবে চালু থাকলেও অধিকাংশতেই কোনও বাজার বসছে না। ফলে এত ভাল পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোনও কেনা বেচাও হচ্ছে না। রামপুরহাট ১ ও ২— দু’টি ব্লকের মান্ডিই রয়েছে সেই তালিকায়। এই বেহাল দশার নেপথ্যে মান্ডিগুলির শহরের বা লোকালয়ের এক প্রান্তে বা লোকালয় থেকে বেশ দূরে থাকাকে যেমন দুষছেন সবাই। তেমনই উঠে আসছে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে (পঞ্চায়েত, পুরসভা বা ব্লক) কৃষি বিপণন দফতরের নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির সমন্বয়ের অভাবের কথাও। পাশাপাশি প্রচারের অভাবকেই দায়ী করছেন কেউ কেউ। ঘর নিতে অনাগ্রহ দেখানোর এ দিনের ঘটনার নেপথ্যেও এই কারণগুলিই উঠে আসছে।
এ দিন লটারিতে অনুপস্থিত থাকা ১৩০ জনের অন্যতম রামপুরহাটের বাসিন্দা সুরজ শেখ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভাল উপার্জন হবে ভেবে একসময়ে মান্ডির ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি দেখছি, তাতে মনে হয় না সেখানে আদৌ বাজার জমবে। তাই ঘর নেব না বলেই ঠিক করেছি।’’ সুরজের যদিও দাবি, এ দিন মান্ডির ঘর বিলি হবে বলেও তাঁকে কেউ জানাননি। আর জানলেও তিনি ঘর নিতে যেতেন না বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। রামপুরহাট ১ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অমল শেখের অভিযোগ, লোকালয় থেকে মান্ডিতে বাজার বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ধরনের প্রকল্পে এলাকার মানুষ কোনও উপকারই পাচ্ছেন না। উল্টে সরকারি জমি নষ্ট করে সেগুলিকে অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া করে দেওয়া হয়েছে বলেই তাঁর দাবি। প্রায় একই সুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সঞ্জীব বর্মন বলছেন, ‘‘গোটা ব্যাপারটিই একটি পরিকল্পনাহীন প্রকল্প। জনগণের পয়সায় লুঠ চলছে।’’
সমস্ত অভিযোগই অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণ সমিতি। সমিতির সচিব শ্যামল মান্না দাবি, উদ্বোধন হওয়া সব মান্ডিই চালু আছে। এমন দাবি করলেও এখনও পর্যন্ত কতগুলি মান্ডিতে প্রশাসন ঘর বিলি করতে পেরেছে, তার হিসেব দিতে তিনি পারেননি। এ দিন কেন ঘর বিলি করা গেল না? তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা এত বিজ্ঞাপন দিয়েছি, এত প্রচার করেছি, তা সত্ত্বেও আবেদনকারীরা কেন এলেন না— তার সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমরা দ্রুত চেষ্টা করব, ওই ঘর বিলি করে দেওয়ার।’’ অন্য দিকে, তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের দাবি, বোলপুর, ইলামবাজারে মান্ডি ভাল সাড়া পেয়েছে। অন্যত্র কী হয়েছে, তাঁর জানা নেই। তবে নতুন জিনিস ঠিক ভাবে চালু হতে সময় লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy