Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ভ্যানিশ সিপিএম, ছাপ্পা অবাধ

বালিতে দিনভর দাপাল বহিরাগতরা

ইভিএমের সামনে যেতেই ‘মার্জিত’ নির্দেশটা শুনলেন প্রবীণ ভোটার— ‘‘আপনি কিন্তু দু’নম্বর বোতামটা টিপবেন স্যার।’’ ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সুঠাম চেহারার এক যুবক। গলাটা তাঁরই।

তৃণমূলের বাইক মিছিল। শনিবার বালিতে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

তৃণমূলের বাইক মিছিল। শনিবার বালিতে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

দেবাশিস দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

ইভিএমের সামনে যেতেই ‘মার্জিত’ নির্দেশটা শুনলেন প্রবীণ ভোটার— ‘‘আপনি কিন্তু দু’নম্বর বোতামটা টিপবেন স্যার।’’ ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সুঠাম চেহারার এক যুবক। গলাটা তাঁরই।

প্রথমে চমকে উঠেছিলেন ওই প্রবীণ। ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে বুথের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন আরও জনা চারেক যুবক। সকলেই অচেনা। লিলুয়ার ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের খেমকা হাইস্কুলে ভোট দিতে আসা প্রবীণকে অগত্যা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির নির্দেশই মানতে হল। লিলুয়া থানা এলাকাতেই মিরপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল। সেখানকার ১৬৮ নম্বর বুথে গিয়ে দেখা গেল, নিয়মমাফিক বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র আড়াল করা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাঝবয়সি এক মহিলা ভোটার সেই ঘেরাটোপে ঢুকতেই ষণ্ডামার্কা একটি চেহারা কাঁধে তোয়ালে ফেলে দৌড়ে এল। আঙুল দিয়ে মহিলাকে দেখিয়ে দেওয়া হল, কোন বোতামটা টিপতে হবে।

এই মুখগুলোকে আগে দেখেননি বালির ভোটাররা। কিন্তু শনিবার পুর নিগমের নির্বাচনে অধিকাংশ বুথে এদের ঠান্ডা গলার নির্দেশই দিনভর শুনতে হয়েছে তাঁদের। যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, শাসানি শুনেছেন। না হয় অশ্লীল গালিগালাজ। আর যেখানে ভোটারদের আসতে দেরি হয়েছে বা আসেননি, তেমন অনেক বুথে এঁরাই বোতাম টিপেছেন। অধিকাংশ বুথেই সিপিএমের এজেন্টদের দেখা যায়নি। বালির জোনাল অফিসে তো ডবল তালা মেরে বসে ছিলেন নেতারা। আড়ালে অবশ্য বলেছেন, বহিরাগতদের নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, তা-ই সত্যি হল। সিপিএম বাদে অন্যান্য বিরোধী দলের যে এজেন্টরা কোথাও কোথাও বসেছিলেন, ‘রা’ কাড়ার সাহস করতে পারেননি তাঁরা।

ঠিক যে অবস্থাটা ছিল পুলিশের। বিরোধী ও ভোটারদের অনেকেই বলেছেন, বালি, লিলুয়া, বেলুড়, ভোটবাগান— সর্বত্রই পুলিশ ও ভোটকর্মীদের দেখে মনে হয়েছে যেন ‘ঝুলনের পুতুল’। তাঁরা সব দেখেছেন, শুনেছেন। কিন্তু কিছুই করেননি।

যেমন লিলুয়ার ওই খেমকা হাইস্কুল। সাড়ে ৭টাতেই একাধিক বুথে ভোটযন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিন-চার জন। প্রত্যেক দলের নেতৃত্বে একটি করে হোমরা-চোমরা চেহারা। ভোটার ইভিএমের সামনে গেলে এঁরাই এগিয়ে যাচ্ছেন। কাকে ভোট দিতে হবে, ‘মনে করিয়ে’ দিচ্ছেন। বিজেপি প্রার্থী যশবন্ত সিংহের অভিযোগ, ওই স্কুলে ৯টি বুথেই এই ভাবে ভোট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘সকাল থেকেই বহিরাগতদের দিয়ে ছাপ্পা ভোট ও রিগিং চলছে। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে বলেও কোনও লাভ হয়নি।’’

বিরোধী সব পক্ষই বলছে, অবাধ ভোট লুঠ হয়েছে কয়েকটি বুথে। ফলে ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই দেখেছেন, তাঁদের ভোট পড়ে গিয়েছে। যেমন রবীন্দ্র সরণির রীতিকা জৈন। খেমকা হাইস্কুলে ভোট দিতে এসেও ফিরে যেতে হল তাঁকে। ৫৯ নম্বর ওর্য়াডের টিআর জিআর উর্দু হাইস্কুলে ভোট দিতে যাওয়া ইজাজ আহমেদ আনসারি, শেখ আলি হোসেনেরও একই অভিযোগ। ভোটাররা যেমন হুমকি শুনেছেন, তেমনই গায়ে হাত পড়েছে বিরোধী প্রার্থীদের। ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী সঞ্জয় বনশল, ৬৩ নম্বরের সিপিএম প্রা‌র্থী মীনাক্ষী বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ কয়েক জনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বাহিনীর বিরুদ্ধে।

প্রাক্তন পুলিশকর্তা তথা স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সুলতান সিংহ প্রচার পর্বে এক দিনও বেরোননি। এ দিন বেরিয়েছিলেন। বললেন, ১৬টি আসনেই তাঁদের জয় নিশ্চিত। প্রচারে বেরোননি কেন? সুলতানের জবাব, ‘‘শরীর ভাল নয়। তাই আসিনি।’’ সুলতান ছাড়াও হাওড়ার একাধিক মেয়র পারিষদ ও তৃণমূল কাউন্সিলররা এ দিন বালি জুড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, আসলে ঘুরে ঘুরে ওঁরা দেখেছেন, ‘ভোট লুট’ সুষ্ঠু ভাবে হচ্ছে কি না। সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারের কথায়, ‘‘হাওড়ার নির্বাচন একটা প্রহসন হয়েছে। তিনটি ওয়ার্ডে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।’’

তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী অরূপ রায় দিনভর এলাকা টহল দিয়েছেন। অভিযোগ শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সিপিএম নিজেই মাঠে নামেনি। তাই সন্ত্রাস হয়েছে ওঁরা বলছেন কী ভাবে? বহিরাগত নয়, মানুষ নিজেই শান্তিতে ভোট দিয়েছে।’’

সহ প্রতিবেদন: দীক্ষা ভুঁইয়া, সুপ্রিয় তরফদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

municipal election bali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE