Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলের পাশেই রয়ে গেল যৌনপল্লি

যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে ধুলিয়ানে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু যৌনপল্লি রয়ে গিয়েছে তার পুরনো স্থানেই। তাতে নিরাপত্তা ও সুস্থ পরিবেশ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন অভিভাবকরা। অন্য দিকে যৌনকর্মীদের দাবি, যথাযথ পুনর্বাসন ছাড়া তাঁদের ঠাঁইনাড়া করা যাবে না। গঙ্গার ধার বরাবর, শতবর্ষ-প্রাচীন কাঞ্চনতলা হাই স্কুলের পাশে গজিয়ে ওঠা পল্লির শতাধিক ঝুপড়িতে প্রায় সাড়ে তিনশো যৌনকর্মী থাকেন। তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই অশান্তির আগুন জ্বলেছে শহরে। কখনও স্থানীয় বাসিন্দারা, কখনও বা স্কুল ছাত্ররা চড়াও হয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওই ঝুপড়িতে।

বিমান হাজরা
ধুলিয়ান শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৩৫
Share: Save:

যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে ধুলিয়ানে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু যৌনপল্লি রয়ে গিয়েছে তার পুরনো স্থানেই। তাতে নিরাপত্তা ও সুস্থ পরিবেশ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন অভিভাবকরা। অন্য দিকে যৌনকর্মীদের দাবি, যথাযথ পুনর্বাসন ছাড়া তাঁদের ঠাঁইনাড়া করা যাবে না।

গঙ্গার ধার বরাবর, শতবর্ষ-প্রাচীন কাঞ্চনতলা হাই স্কুলের পাশে গজিয়ে ওঠা পল্লির শতাধিক ঝুপড়িতে প্রায় সাড়ে তিনশো যৌনকর্মী থাকেন। তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই অশান্তির আগুন জ্বলেছে শহরে। কখনও স্থানীয় বাসিন্দারা, কখনও বা স্কুল ছাত্ররা চড়াও হয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওই ঝুপড়িতে। পুড়ে ছাই হয়েছে ঝুপড়ি। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই ফের গজিয়ে উঠেছে সেই ঝুপড়ি। ফিরেছেন যৌনকর্মীরাও। তা নিয়ে বারবার সঙ্কটে পড়েছেন ১১৭ বছরের প্রাচীন কাঞ্চনতলা হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছুটে আসতে হয়েছে পুলিশকে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফায়জুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত কোএডুকেশন স্কুল এটি। অশান্তির ভয়ে ঝুপড়ি লাগোয়া স্কুলের প্রাচীর বাড়িয়ে উঁচু করা হয়েছে। অনেকটাই ছাত্রদের নজর ঠেকাতে। তাতেও অস্বস্তি কাটেনি।”স্কুলের সম্পাদক ধুলিয়ান শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মেহেবুব আলম বলেন, “আমার মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুল যাতায়াতের পথে তাই কিছুটা উদ্বেগে থাকতেই হয় সব সময়। কারণ এই সব ঝুপড়িতেই এলাকার দুষ্কৃতীদের আনাগোনা। তাই সবাই চায় স্কুলের গা ঘেঁষে থাকা এই সব ঝুপড়ি সরে যাক অন্যত্র।” তাঁর অভিযোগ, এ নিয়ে স্কুল থেকে প্রশাসন ও পুরসভার কাছে বারবার লেখাও হয়েছে। কিন্তু কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুজিত মুন্সি মনে করেন, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই ঝুপড়ি হঠাত্‌ করে পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। তাঁর কথায়, “প্রশাসনিক চাপে পুলিশ দিয়ে এদের তুলে দেওয়া হলে এরা এই এলাকা থেকে উঠে গিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গিয়ে বসতি গড়বে। তাতে সমগ্র শহরের সামাজিক পরিবেশটাই আরও নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি পরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাও জরুরি। সেক্ষেত্রে অন্তত ওই ঝুপড়ির পরিবেশটা পরিচ্ছন্ন করে কিছুটা সুস্থতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।” তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে একসময় শহরের কিছু মানুষকে নিয়ে আমরা উদ্যোগী হয়েছিলাম। পুরসভা, ব্লকের সরকারি আধিকারিদের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে নানা কারণে সে আলোচনা আর এগোয়নি।”

এক সময় সরাসরি এই যৌনপল্লীতে গিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজ করেছেন ‘সুপ্রভা পঞ্চশীলা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের হিসেব, প্রায় ৩৮০ জন মহিলা রয়েছেন এখানে। পালাপার্বণে সংখ্যাটা বাড়ে। ৬০টির মতো শিশু রয়েছে এদের পরিবারে। সংস্থার কোঅর্ডিনেটর সোমা ভৌমিক বলেন, “আমাদের তথ্য অনুযায়ী সব মিলিয়ে ৩৮০ জন মহিলা-সহ এদের পরিবারে লোকসংখ্যা ৪৬৫ জন মত। আগে এদের পরিবারের শিশুদের নিয়ে একটি স্কুল চালাতাম আমরা, এখন অর্থাভাবে তা বন্ধ। বন্ধ মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজও। অথচ নতুন মেয়েরা আসছে এখানে। ঝাড়খন্ড, বিহার, বীরভূম, এমনকী ডোমকল থেকেও মেয়েরা কাজের জন্য আসছে এখানে।”

সোমাদেবীর অভিযোগ, সরকারি পর্যায়ে এই গরিব মেয়েদের জন্য কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ তো দূরের কথা। বেসরকারি অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভর করেই কাজ চলছিল এতদিন ধুলিয়ানে। এখন তা-ও বন্ধ। এখানকার শিশুদের স্থানীয় সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তি করা, নিয়মিত স্কুলে পাঠানোও সমস্যা হচ্ছে।

ধুলিয়ান পুরসভার উপ-পুরপ্রধান তৃণমূলের দিলীপ সরকার বলেন, “কয়েক যুগ ধরে ওই ঝুপড়ি রয়েছে। তা তুলে দিতে স্থানীয় মানুষজন বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। এদের তুলে দিতে হলে আগে তাদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা তো পুরসভার পক্ষে করা সম্ভব নয়।” তৃণমূলের সামশেরগঞ্জ ব্লক সভাপতি ও ধুলিয়ানের প্রাক্তন কাউন্সিলার কাউসার আলি আবার মনে করেন, এই মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাটাই জরুরি। কারণ হঠাত্‌ করে এরা বাধ্য হয়ে আরও ছড়িয়ে পড়বে। তাতে সমস্যা কমবে না।

কিন্তু এই মেয়েদের পুনর্বাসন দিতে শুধুমাত্র আবাসন গড়ে দিলেই তো হবে না, তার জন্য সরকারি জমি চাই। “ধুলিয়ান শহরের মধ্যে অত সরকারি জমি কোথায়?” প্রশ্ন করেন কাউসার আলি। “বর্তমানে যে জমিতে ওই ঝুপড়িগুলি রয়েছে সেটি ব্যক্তি মালিকানার জমি। সেখানে ঝুপড়ি প্রতি ভাড়াও আদায় হয়। কাজেই সেই বেসরকারি জমিতে সরকারি স্তরে তাদের জন্য কোনও পুনর্বাসন প্রকল্প রচনা করা প্রায় অসম্ভব।”

এই ঝুপড়িরই বাসিন্দা জরিনা বিবি (নাম পরিবর্তিত) এসেছেন ডোমকল থেকে। স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে এখানে থাকেন বছর তিরিশের জরিনা। তার কথায়, “এই ঝুপড়ি থেকে সামাজিক জীবনে ফেরার কোনও পথ নেই আমার সামনে। শহরের এক প্রান্তে এভাবেই বেঁচে আছি আমরা। মানুষে ক্ষোভ, পুলিশের শাসানি এবং দুষ্কৃতীদের অত্যাচারের শিকার হতে হয় আমাদের নিত্যদিনই।” সুস্থ ভাবে পুনর্বাসন পাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায়? সে আশা করেন না জরিনা।

চোদ্দ বছর বয়সে এখানে এসেছিলেন সাজিদা বেওয়া (নাম পরিবর্তিত)। এখন বয়সের হিসেব আর মনে পড়ে না। সাজিদা বলেন, “এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য নিয়ে দুই মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। বিয়েও দিয়েছি তাদের আশপাশেই দুই গ্রামে। মেয়েদের এ পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও আমি আর এই ঝুপড়ি ছেড়ে যেতে পারিনি।”

প্রাক্তন পুরপ্রধান সিপিএমের চেনবানু খাতুন অবশ্য এক সময়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সরিয়ে, পুরসভা থেকে পরিকল্পিতভাবে পাকা ঘর তৈরি করে দিতে। ভাড়ার বিনিময়ে যৌনকর্মীদের যথাযথ পুনর্বাসন দিতে। তত্‌কালীন মহকুমাশাসকও আশ্বাস দেন, ধুলিয়ান পুরসভা তাদের পুনর্বাসনে কোনও প্রকল্পের প্রস্তাব দিলে রাজ্যের সমাজ কল্যাণ দফতরের মাধ্যমে তা রূপায়ণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু জমির অভাবে ভেস্তে যায় সব প্রচেষ্টাই।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE