Advertisement
০২ মে ২০২৪
Krishnanagar

টিউশন ফি বাকি, কৃষ্ণ সেজে রোজগারের আশায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরছে ‘বহুরূপী’ কিশোর

পুজোর সময়ে এমনই ভোরবেলায় উঠতে হয় প্রসেনজিৎকে। সে থাকে বর্ধমানের দাইহাটের ন-পাড়ায়। দিদার বাড়িতে। প্রসেনজিতের মা মারা গিয়েছে ছোটবেলায়।

দিদার সঙ্গে প্রসেনজিৎ ও তার বোন জয়া। নিজস্ব চিত্র

দিদার সঙ্গে প্রসেনজিৎ ও তার বোন জয়া। নিজস্ব চিত্র

সুদীপ ভট্টাচার্য
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২২ ০৮:৪০
Share: Save:

ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। দিদার ডাকে ঘুম ভেঙে যায় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র প্রসেনজিৎ দেবনাথের। কাজে বেরতে হবে যে।

এই ক’দিন কিশোরের দারুণ ব্যস্ততা। ঘুম চোখে তাড়াতাড়ি একটা বাজারের থলেয় সব গুছিয়ে নেয় সে। বহুরূপী সাজার জিনিসগুলো গুছিয়ে দিদার সঙ্গে সবে বেরতে যাবে, বিছানা থেকে উঠে বায়না জুড়ে দেয় জয়া। কিশোরের নয় বছরের বোন। তাকেও নিয়ে যেতে হবে। দিদার সঙ্গে দাইহাট স্টেশনের দিকে পা বাড়ায় দুই ভাই-বোন। গন্তব্য কৃষ্ণনগর। দু’মাসের টিউশন ফি বাকি পড়ে আছে। বহুরূপীর সাজে কৃষ্ণ সেজে তাই দিদার সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপে-মণ্ডপে ঘুরছে ওই ছাত্র। যদি কিছু রোজগার হয়!

পুজোর সময়ে এমনই ভোরবেলায় উঠতে হয় প্রসেনজিৎকে। সে থাকে বর্ধমানের দাইহাটের ন-পাড়ায়। দিদার বাড়িতে। প্রসেনজিতের মা মারা গিয়েছে ছোটবেলায়। বাবা তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য কোথাও। ভরসা বলতে দিদা। দিদার বাড়িতে মামা, মামির সঙ্গে বসবাস দুই ভাই-বোনের। অন্য দিন প্রসেনজিৎ দিদার সঙ্গে বহুরূপী সেজে কাজে বেরোলে জয়া থাকে মামির কাছে।

ফি-বছর জগদ্ধাত্রী পুজোয় কৃষ্ণনগর চাষাপাড়ার বুড়িমা তলায় কৃষ্ণ সেজে দাড়িয়ে থাকে প্রসেনজিৎ। দিদাই তাকে সাজিয়ে দেয়। প্রসেনজিতের দিদা রাধারানি রায় চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের মায়ের বাড়ির দিকে সবাই বহুরূপী সাজত। আমিও ছোটবেলায় কৃষ্ণ সেজেছি।’’

পুজোর সময়টায় বহুরূপী সেজে রোজগার করতে গিয়ে পড়া কামাই হয় প্রসেনজিতের। টিউশন যাওয়া হয় না। তাতে কী! পেট বড় বালাই।

এমনি সময়ে শনি-রবি কৃষ্ণ সেজে আশপাশের গ্রামে ঘোরে প্রসেনজিৎ। সঙ্গে থাকেন রাধারানি। কিন্তু গ্রামের দিকে চাল, ডাল, আলুর বেশি খুব কিছু জোটে না। টাকা মেলে পুজো-পার্বনে শহরে গেলে। এ দিকে, টাকার অভাবে বাকি পড়েছে দুই মাসের টিউশন ফি। কিশোরের দিদা বলেন, ‘‘দিদিমণি বড় ভাল। বলেছি জগদ্ধাত্রী পুজোয় ঘুরে এসে যা রোজগার হবে, তা দিয়ে ফি মিটিয়ে দেব।’’

কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো বুধবার। তার আগে সোমবার এক বার ঘুরে গিয়েছেন রাধারানি আর কৃষ্ণরূপী কিশোর। সারা দিনে যা রোজগার হয়েছে, তা থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা জ্যামিতি বক্স কিনেছে প্রসেনজিৎ। ফের মঙ্গলবার সকালেও বেরিয়ে পড়েছে দিদা-নাতি। বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে দাইহাট স্টেশন। তার পর ট্রেনে চেপে নবদ্বীপ। সেখানে ঘুগনি-রুটি খেয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে প্রসেনজিৎকে কৃষ্ণ সাজিয়েছেন রাধারানি। শেষে বাসে করে সোজা কৃষ্ণনগর।

কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কিছু সাজা হয় না কিশোরের। বার্ধক্য ভাতার টাকায় কৃষ্ণের সাজ কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন রাধারানি। সেই দিয়েই চলছে। ইচ্ছে ছিল, জগদ্ধাত্রী পুজোয় নাতিকে জগদ্ধাত্রী সাজিয়ে বুড়িমা তলায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু অত টাকা কোথায়?

মঙ্গলবার সকালে বুড়িমা তলার ভিড়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এ দিক-সে দিক ঘুরে একটু বেলায় আবার বুড়িমা তলায় ফিরে আসে কৃষ্ণ। মাঝে খাওয়া বলতে কয়েক কাপ চা। এ ভাবেই দিন কাটে। বিকেল হয়। সারা দিনে কেউ প্রণাম করে। কেউ সেলফি তোলে। যার ভাল লাগে, সে কিছু অর্থসাহায্য করে।

রাধারানি বলেন, ‘‘আসলে ভগবান সাজে তো। অনেকে প্রণামও করেন কৃষ্ণকে। তাই খালি পায়েই ঘুরতে হয়।’’

দিনের শেষে ফাটা পায়ে যখন ফেরার বাস ধরে কৃষ্ণ, তখন তার ছোট্ট দু’পায়ে ধুলোমাখা ব্যথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Krishnanagar Krishna Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE