Advertisement
১১ মে ২০২৪

দেবতার প্রাণ জুড়োয় শরবতে আর পখালে

সাদা কুন্দফুলের পাপড়ির মতো সুগন্ধি গোবিন্দভোগ চাল বা বাসমতী চালের সুসিদ্ধ অন্ন। রান্নার পরে তাকে পোড়ামাটির পাত্রে (বিকল্পে পিতল বা তামার পাত্র) বরফ ঠান্ডা গোলাপজলে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পরে তাতে মেশানো হবে জিরে ভাজার মিহি গুঁড়ো, আদা, কাঁচালঙ্কা কুচো। চাইলে মেশানো যেতে পারে আধভাঙা কাজু, পেস্তা।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০০:৫৯
Share: Save:

সাদা কুন্দফুলের পাপড়ির মতো সুগন্ধি গোবিন্দভোগ চাল বা বাসমতী চালের সুসিদ্ধ অন্ন।

রান্নার পরে তাকে পোড়ামাটির পাত্রে (বিকল্পে পিতল বা তামার পাত্র) বরফ ঠান্ডা গোলাপজলে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পরে তাতে মেশানো হবে জিরে ভাজার মিহি গুঁড়ো, আদা, কাঁচালঙ্কা কুচো। চাইলে মেশানো যেতে পারে আধভাঙা কাজু, পেস্তা।

এ বার পাত্র বদল। ওই সুগন্ধি সুশীতল অন্ন ঢালা হবে পাথরের বড় পাত্রে। তাতে মিশবে সাদা টক দই এবং সবশেষে কয়েক ফোঁটা গন্ধরাজ লেবুর রস। ব্যস, চেনা পান্তা এ ভাবেই বদলে যায় দেবভোগ্য ‘পখাল’ বা ‘পাখালে’। ওড়িশার খেতে-খামারে কাজ করা, রোদে পোড়া মানুষদের সর্দিগর্মি ঠেকাতে ওই পখাল নাকি অবর্থ্য মহৌষধ। সেখানে সকালে আলাদা ভাবে ভাত রান্নাই করা হয় পখালের জন্য। বাংলার ‘পান্তা’-ই ওড়িশায় ‘পখাল’— জানালেন দীর্ঘদিন পুরীতে কাটিয়ে আসা নবদ্বীপ জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস।

শুধু পখাল বলে নয়, গরমের কারণে নবদ্বীপের মঠে-মন্দিরে আমূল বদল ঘটে যায় দেবতার ভোগের পদেও। সকালের বাল্যভোগ থেকে রাত্রিকালীন ভোগ— সবেতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায় গরমকালে। যেমন, ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরে গরম পড়তেই বেড়ে যায় ফলের ব্যবহার। মধ্যাহ্নে পখাল, বিকেলে ডাব। ধোঁকা বা ছানা-পনিরের পদ কমিয়ে তার জায়গায় বাড়িয়ে দেওয়া হয় সব্জির পদ। মন্দিরের সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানিয়েছেন, শুধু খাদ্যতালিকা নয় মন্দিরের গর্ভগৃহে টেবিল, সিলিং এবং এক্সজস্ট মিলিয়ে পাঁচটি ফ্যান সব সময়ে চলে। যত বার আরতি হয়, গঙ্গাজলে তোয়ালে ভিজিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হয় মহাপ্রভুর বিগ্রহের গা। পরানো হয় সুতির হাল্কা চাদর এবং ধুতি। এই গরমে সমাজবাড়ির দেবতা ভোগে সবার আগে জায়গা করে নেয় টক-জাতীয় খাবার। টক ডাল, চাটনি, নানা ধরনের আচার প্রতি দিনের ভোগে দিতেই হয়। সঙ্গে মরসুমি ফল। সমাজবাড়ির এক সেবক জনক দাস বলেন, “রাতের ভোগে পুরি-কচুরি দেওয়া হয় আমাদের মন্দিরে। কিন্তু গরম পড়তেই সে সব বন্ধ করে হাতে গড়া রুটি তরকারি এবং মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়।” দিনের বেলা দেবতাকে দেওয়া হয় শরবত। আগের রাতে মিছরি ভিজিয়ে রেখে সকালে তাতে বিট লবণ, গোলমরিচ আর পাতি লেবু মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই শরবত।

তবে শরবত ভোগের বৈচিত্র্যে নবদ্বীপের মদনমোহন মন্দির অতুলনীয়। বৈশাখ মাস পড়তেই মদনমোহনকে প্রতি দিন বিকেলে নয় রকমের শরবত ভোগ দেওয়া এই মন্দিরের রীতি। মিছরি, তরমুজ, ঘোল, বেল পানা, ছানা পানা, শিখরিণী সরবত, ঠান্ডাই, গোলাপ কন্দের সরবত প্রভৃতি নয় রকমের শরবত গরমকাল জুড়ে প্রতিদিন বিকেলের ভোগে নিবেদন করা হয়। মধ্যাহ্নের ভোগে বাধ্যতামূলক যবের ছাতু, আখের গুড়, কাঁঠালি কলা।

মদনমোহন মন্দিরের নিত্যগোপাল গোস্বামী জানান, “প্রতি দিন বিকেলে ন’রকমের সরবতই ভোগে দিতে হয়। দই, দুধ, কাজু বাটা, জিরের গুঁড়ো দিয়ে হয় শিখরিণী সরবত। ঠান্ডাই তৈরি হয় পোস্ত, কাঠবাদাম, পেস্তা, গোলমরিচ বাটা দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে। উপরে ছড়ানো থাকে গোলাপের পাপড়ি।” সরবতের সঙ্গে দেওয়া হয় ফল। মুগডাল ভেজানো, ছোলা ভেজানো, কাঠবাদাম, পেস্তা, খেজুর এবং কাজু থাকতেই হবে ভোগের থালায়। সঙ্গে অন্যান্য মরসুমি ফল। প্রতি দিন সাত রকমের পদ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোগ হয় মদনমোহনের। গরমে দুপুরের ভোগে থাকতেই হবে সাদা নটেশাক আর কাসন্দ। জ্যৈষ্ঠ মাস পড়তেই বিকেলের ভোগের তালিকায় ঢুকে পড়ে চিঁড়ের সঙ্গে ক্ষীর, কলা, আম ও মিষ্টি।

আসলে ঠাকুরবাড়ির যে কোনও ভোগের একটা নিজস্ব স্বাদ আছে, গন্ধ আছে। গৃহস্থ বাড়ি বা অন্য কোনও রান্নাঘরের থেকে একদম আলাদা এক পবিত্র গন্ধে ভরে থাকে দেবালয়ের পাকশালা। সকাল-সকাল স্নান-জপ সেরে, শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে দীর্ঘকায় এক বৈষ্ণব অথবা রসকলি আঁকা কোনও বোষ্টমী গুনগুন করে মহাজনপদ ভাঁজেন আর নিজের মনে রান্না করেন দেবতার প্রিয় পদগুলি। পখাল ভোগের স্বাদ নিতে লাইন পড়ে যায় মন্দিরে। দেবতাকে পখাল নিবেদনের সময়ের এবং স্বাদের হেরফের থাকে। বর্ষা নামলেই পখালের দিন শেষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nabadwip food god debashis bandopadhyay temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE