E-Paper

দুঃস্বপ্নের সন্ধে আর বদলে যাওয়া জীবন

স্বামীর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিনটা ভোলেননি সজনী। পাশের গ্রামের শম্ভুলাল, শিলবানুস ও আরও কয়েক জনের সঙ্গে কেরলে যাবেন বলে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন মুন্সি।

ছন্দক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৫৫
বালেশ্বরের বাহানগা স্টেশনের কাছে ট্রেন দুর্ঘটনা। — ফাইল চিত্র।

বালেশ্বরের বাহানগা স্টেশনের কাছে ট্রেন দুর্ঘটনা। — ফাইল চিত্র।

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আগের দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর নিশ্চিন্ত ঘুমের আশ্রয়ে সাগরদিঘির আদিবাসী বেলডাঙার মাদারগাছি গ্রাম। এমন সময় সুদূর ওড়িশা থেকে এসেছিল একটা ফোন। ওই গ্রামের মুন্সি টুডুর বাড়ি থেকে ভেসে আসে স্বজন হারানোর কান্না। ভোরের নিস্তব্ধতা খানখান করে দেয়।

পাশের গ্রামের শম্ভুলাল কিস্কু ফোনটা করেছিলেন। মুন্সির দাদা সাগর টুডুকে তিনি জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ওই বাড়ির ছোট ছেলে। খোঁজ নেই শিলবানুস নামে তাঁদের সঙ্গে থাকা আরেক যুবকেরও (দুর্ঘটনার পরদিন উদ্ধার হয়েছিল শিলবানুসের নিথর দেহ)। গত ২ জুন ওড়িশার বাহানাগা বাজারে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় স্বামী মুন্সিকে হারিয়েছেন সজনী টুডু। ভোররাতের সেই ফোন আঁধার ডেকে এনেছিল মধ্য কুড়ির তরুণীর জীবনেও।

ওই দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত সজনীর দিনের বেশির ভাগটা কাটত বাড়ির দৈনন্দিন কাজকর্ম করে। সকালে উঠোন ঝাঁট, মাটির বাড়িতে গোবর নিকোনো, পোষা মুরগিকে খুদকুঁড়ো দেওয়া, কাঠের উনুন ধরিয়ে বাড়ির সকলের রান্নার ব্যবস্থা করা—লেখাপড়া না জানা (সদ্য নিজের নাম সই করতে শিখেছেন তিনি) এক গ্রাম্য গৃহবধূর মতোই সেই নিত্তনৈমিত্তিকতা। হাতা-খুন্তি ধরা সেই হাতই এ বারের পুজোয় লাঠি নিয়ে রাস্তার ভিড় সামলাবে।

স্বামীর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিনটা ভোলেননি সজনী। পাশের গ্রামের শম্ভুলাল, শিলবানুস ও আরও কয়েক জনের সঙ্গে কেরলে যাবেন বলে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন মুন্সি। আগেও তাঁরা বারকয়েক সেখানে গিয়েছেন। প্রতিবার এ ভাবেই বাড়তি রোজগারের আশায় এক-দু’মাসের জন্য ভিন রাজ্যে যেতেন। বছরের বাকি সময় গ্রামে চাষবাস করে কাটত তাঁর। ভোরে উঠে স্বামীর জন্য ভাত রেঁধে দেন সজনী। মুন্সি ট্রেনে খাবেন বলে পুঁটলিতে বেঁধে দেন ভাত, ডাল, আলুর তরকারি এবং শুকনো খাবার। নিজের হাতে যত্ন করে সব গুছিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ ও সাত বছরের ছেলে ও মেয়েকে বুকে টেনে একটু আদর। তারপর বাড়ির সকলকে বিদায় জানিয়ে মুন্সি বেরিয়ে পড়েন। স্বামী রওনা হওয়ার সময় সেদিন অনেক ক্ষণ তাঁর যাত্রাপথের দিকে চেয়ে ছিলেন সজনী। এক মাস পর বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এ ভাবে মুন্সি যে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে যাবেন, দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি সজনী।

‘‘ছেলেটার বয়স সবে পাঁচ। এখনও সব কিছু বোঝার বয়স হয়নি। প্রথম প্রথম বাবার কথা খুব জিজ্ঞাসা করত। এখন বাবার কথা উঠলে চুপ করে যায়। গ্রামের লোকজনের কাছে শুনেছে বোধহয়। হয় তো বুঝেছে, বাবা আর কোনও দিনও আসবে না।’’— ধরা গলায় বলেন সজনী। কিছুটা সামলে নিয়ে ফের বলতে শুরু করেন, ‘‘সারা দিন মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনি। পুজোর সময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব বেশি বেরোতে পারত না ওদের বাবা। আমিই ওদের পুজোমণ্ডপে নিয়ে যেতাম। তবে কার্তিক পুজোর সময় গ্রামে বড় মেলা বসে। নিয়ম করে ছেলেমেয়েকে সেই মেলায় নিয়ে যেতেন উনি। বাচ্চাদের খেলনা কিনে দিতেন। পান্তা ভাত খেতে বড্ড ভালবাসত মানুষটা। হঠাৎ কোথায় উবে গেল।’’

স্বামীর মৃত্যুর পর সরকারের দেওয়া হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছেন সজনী। কর্মক্ষেত্র জঙ্গিপুর। শ্বশুর-শাশুড়ি, জা-ভাসুরের কাছে ছেলেমেয়েকে রেখে সেখানেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। ছুটিতে বাড়ি আসেন। ছেলেমেয়েদের চাওয়া-পাওয়ার তেমন খেয়াল রাখার ফুরসত পান না আর। দাদু লুবিন, ঠাকুরমা রুপি আর জ্যাঠা-জ্যেঠিমার স্নেহে বড় হচ্ছে দুই একরত্তি। পুজোয় ছেলেমেয়েকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবেন? মাথা নাড়েন সজনী— ‘‘পুজোর সময় বাড়ি থাকতে পারব না। ডিউটি পড়েছে। বাড়ির লোকেরাই ওদের নিয়ে যাবেন হয় তো।’’

দৃশ্যপটে ফের সাড়ে চার মাস আগের একটা ছবি। দুর্ঘটনায় গ্রামের ছেলের মৃত্যুর খবর রটে যাওয়ার পর সকাল থেকে বাড়িতে একে একে আত্মীয়-স্বজনেরা আসা শুরু করেছেন। কেউ সান্ত্বনার হাত রাখছেন সজনীর মাথায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সদ্য স্বামীহারার। উঠোনের এক কোণে শূন্যদৃষ্টি নিয়ে চুপ করে বসে তিনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। তাদের জীবনে কোন বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা বুঝতে না পারা একটি বাচ্চা মেয়ে চেয়ে রয়েছে মার দিকে।—— ‘‘সেই সময় সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সরকার পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।’’ গলার স্বর দৃপ্ত সজনীর। প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ‘দশভুজা’ হয়ে উঠেছেন এক তরুণী। ২ জুনের সন্ধে আমুল বদলে দিয়েছে তাঁর সব কিছু।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Accident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy