Advertisement
E-Paper

জ্বলজ্বল করছে গো-দানোর চোখ দু’টো

চাচা ভিজে মাথালটা বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রাখলেন। বাইরে বৃষ্টির থামাথামির কোনও লক্ষণ নেই। চিনি ছাড়া চায়ে সুড়ুৎ করে চমুক দিয়ে চাচা ধরলেন, ‘সে বার জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ছে, বুঝলে ।

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০৮:১০

খড়ের ছাউনি ও পাটকাঠি বেড়ার এক চিলতে ঘরে থিকথিক করছে ভিড়। পাড়ার প্রবীণ মাতব্বর থেকে সদ্য যুবক সকলেই চাতকের মতো অপেক্ষা করছেন। কিন্তু যাঁর জন্য এই পথ চাওয়া, ডোমকলের কুপিলা গ্রামের আজমতুল্লা শেখের দেখা নেই। গ্রামের ছেলেবুড়ো সকলের কাছেই আজমতুল্লা চাচা বলেই পরিচিত। আজমতুল্লা এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু বর্ষা এলেই তাঁর বলা গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ঘোরে। হাসতে হাসতে তিনি বলতেন, ‘এক বার ডাকঘরে গিয়ে আমি নিজের নামও ভুল করে বলেছিলাম চাচা শেখ!’ যাইহোক, চাচা ঢুকতেই সকলেই ব্যতিব্যস্ত।

—‘এই সরিফুল, তুই ওখানে বসে কেন?’

—‘এই চাচার বিড়ির বান্ডিলটা কোথায়?’

—‘আব্দুস চাচার চায়ে চিনি দিবি না কিন্তু।’

চাচা ভিজে মাথালটা বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রাখলেন। বাইরে বৃষ্টির থামাথামির কোনও লক্ষণ নেই। চিনি ছাড়া চায়ে সুড়ুৎ করে চমুক দিয়ে চাচা ধরলেন, ‘সে বার জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ছে, বুঝলে । মাঘ মাস আসতে তখনও বেশ কয়েক দিন দেরি। আচমকা অকাল বৃষ্টি। ভয়ে লোকজন খেতের ফসল কেটে বাড়িতে তুলছেন। আমাদের জমিতে কলাইও পেকে গিয়েছে। কিন্তু সে দিন বাড়িতে লোক না থাকায় আমি একাই মোষের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম কলাই কাটতে। পৌঁছতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পথে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে দেখাও হল। তারা কাজ সেরে ততক্ষণে বাড়ি ফিরছে। গাড়ি থেকে মোষ জোড়াকে পাশের একটি বাবলা গাছে বেঁধে কলাই কাটতে শুরু করি। সকাল থেকে আকাশ মেঘলাই ছিল। আচমকা ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। একে ঠান্ডা, তার উপরে বৃষ্টি। আশপাশের খেতে কেউ নেই। কেন জানি না, একটু ভয় পেলাম। মনে হল পিছন দিয়ে কেউ এক জন দৌড়ে চলে গেল। পিছু ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। ভাবলাম, মনের ভুল।

এই পর্যন্ত বলে চাচা থামতেই লোকজন উদগ্রীব হয়ে ওঠে। প্রবীণ গয়েশ চাচা এ বার একটা বিড়ি ধরিয়ে চাচার হাতে দেন। চাচা বলেন, ‘এই, এই নীল সুতোর বিড়িটাই মনে মনে চাইছিলাম।’ কলেজ পড়ুয়া আব্বাস বলেন, ‘ও চাচা, থামলে কেন? এমন সময় কেউ থামে? তার পর কী হল?’

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ফের শুরু করেন চাচা, ‘বেলা পড়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে কলাই তুলে মোষ জোড়া আনতে গিয়ে, তারা নেই। পড়ে আছে শুধু দু’টো রশি। বেশ কিছুক্ষণ এ দিক ও দিক খুঁজলাম। কিন্তু না, কোথাও নেই। এ দিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত জোয়াল কাঁধে দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। আমাকে দেখে মা শুধোয়, কী রে মোষ কোথায়?’ কোনও কথা না বলে এক জামবাটি মুড়ি-জল খেয়ে ফের মাঠের দিকে হাঁটা দিলাম। তখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।’ সহিদুল বললেন, ‘একে শীতের রাত। তার উপর বৃষ্টি। ভয় করেনি?’

চাচা বলেন, ‘শোন না আগে পুরোটা। আমি মাঠে এ দিক ও দিক খুঁজছি। ঘণ্টা দেড়েক পরে দেখি দূরের মাঠে মোষ দুটো ঠায় দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই সে দু’টো আমার দিকেই চলে এল। হাঁফ ছেড়ে আমি ওদের নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। আমার ডান দিকে হাঁটছিল দু’টোতে। কিছুটা এগিয়ে দেখি সে দু’টো নেই। আমার বাঁ দিকে তারা দাঁড়িয়ে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে দু’জোড়া চোখ। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও ফের হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু দূর গিয়ে দেখি, মোষগুলো নেই। এ দিক ও দিক ঘুরতেই দেখি, সেগুলি ফের ডান দিকে দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি।’ নিভে যাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে চাচা বলেন, ‘কোনও রকমে মোষজোড়া গোয়ালে ঢুকিয়ে মা-কে ডাকি। হ্যারিকেন হাতে মা বলে, ‘কই রে মোষ কোথায়?’ কেন ওই তো বলে আমি যেই গোয়ালের ভিতরে তাকিয়েছি। দেখি, সেটা ফাঁকা।’ সমস্বরে প্রশ্ন, ‘তা হলে চাচা, তুমি যাদের এনে গোয়ালে ঢোকালে তারা কী?’ চাচা বলেন, ‘মানুষ মরে ভূত হয়, আর গরু-মোষ মরে গো-দানো।’

বাইরে তখন একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে।

(চলবে)

Monsoon Story
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy