Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

অঙ্গরাগ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিল্পী

রাত ন’টা। শয়ন আরতির পর বন্ধ হয়ে যায় নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের সিংহ দরজা। তখন সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। রাতের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন মন্দির হয়ে ওঠে রহস্যময়, গা ছমছমে। বড় বড় থাম, দালান, খিলান, সিঁড়ি সবই কেমন অপার্থিব রূপ নেয়।

নিজের কর্মশালায় ব্যস্ত দুলাল চক্রবর্তী।

নিজের কর্মশালায় ব্যস্ত দুলাল চক্রবর্তী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রাত ন’টা। শয়ন আরতির পর বন্ধ হয়ে যায় নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের সিংহ দরজা। তখন সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। রাতের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন মন্দির হয়ে ওঠে রহস্যময়, গা ছমছমে। বড় বড় থাম, দালান, খিলান, সিঁড়ি সবই কেমন অপার্থিব রূপ নেয়।

কেবল বছর দুয়েক অন্তর মাত্র পনেরোটা দিনের জন্য এই পৌষ মাসে সেই নৈশ মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান কেবল একজন রূপদক্ষ। এক পক্ষকাল ধরে শুদ্ধবস্ত্র পড়া সেই মৌন পুরুষ নিজের হাতে ‘অঙ্গসেবা’ করেন ধামেশ্বর মহাপ্রভুর। তাঁর এক হাতে তুলি অন্য হাতে প্রদীপ। বড় যত্নে নিজের হাতে একটু একটু করে নির্মাণ করেন শ্রীবিগ্রহের দেহত্বক। নিপুণ হাতে ঘষে মেজে ফিরিয়ে আনেন নবীন গৌরকান্তি।

এমন করে পনেরো দিনের শেষে মধ্যপৌষের এক কনকনে রাতে গোটা পৃথিবী যখন ঘুমে অচেতন, বহু যত্নে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথের’ বিগ্রহে চক্ষুদান করেন তিনি। সমাপ্ত হয় পাঁচশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহের অঙ্গরাগ। তুলি নামিয়েই শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রায় বৃদ্ধ মানুষটি। কী জানি আবার তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হবে তো?

এ ভাবেই পুরুষাণুক্রমে নবদ্বীপের বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত ধামেশ্বর মহাপ্রভু বিগ্রহের অঙ্গরাগ করে আসছেন দুলাল চক্রবর্তী। ইতিহাস বলে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। বিরহ কাতর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদেশ পেয়ে চৈতন্যদেবের মূর্তি গড়েন। সেই বিগ্রহের সেবা পুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।

মহাপ্রভুর বিগ্রহ। নিজস্ব চিত্র

চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিন বছর পরে, ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয়, যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে ‘১৪৩৫ শক, বংশীবদন’। অনুমান বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। সারা বিশ্বের মানুষ নবদ্বীপে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানেই। নির্দিষ্ট সময় বাদে এ বছর পয়লা জানুয়ারি অঙ্গরাগের পরে মহাপ্রভুর পুনরাভিষেক ঘিরে মেতে উঠছিল নবদ্বীপ।

এই বিগ্রহের সঙ্গে দুলাল চক্রবর্তী বা তাঁর পূর্বপুরুষদের যোগাযোগ এতই প্রাচীন যে তার উৎস খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক কবে থেকে কী ভাবে তাঁরা অঙ্গসেবার দায়িত্ব পেলেন সে কথার পাথুরে প্রমাণও নেই। তবে দুলালবাবু জানান, তিনি শুনেছেন, তাঁর পূর্বপুরুষের হাতেই নাকি ওই বিগ্রহের নির্মাণ। তাঁদের আগের বাসস্থান ছিল সংলগ্ন বর্ধমানের কোনও অঞ্চল। তখন তাঁদের পদবী ছিল আচার্য। প্রসঙ্গত, নবদ্বীপ মালঞ্চপাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জন্মভিটে লাগোয়া যে পাড়ায় দুলালবাবুর বাড়ি, সেই পাড়ার নামও আচার্য পাড়া।

নবদ্বীপ মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইত গোস্বামীদের ভরসাও বংশানুক্রমে সেই শুনে আসা কাহিনি। সেবাইত সুদিন গোস্বামী, পুলক গোস্বামী, রূপ গোস্বামীরা জানান, বহু বছর ধরে ওই পরিবারের শিল্পীরাই এই মূর্তির অঙ্গসেবা করেন। অনেক আগে ওঁদের বাদ দিয়ে এক বার অন্য এক শিল্পী অঙ্গরাগ করেছিলেন। কিন্তু সে মূর্তি দেখে বেজায় চটে যান ভক্তেরা। বাধ্য হয়ে সেই দিনই ফের আবার নতুন করে অঙ্গরাগ করাতে হয়েছিল দুলালবাবুর ঠাকুর্দা বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীকে দিয়ে। তার পর থেকে আর ওই চেষ্টা করা হয়নি।

পয়লা পৌষ বিশেষ ভোগ আরতির পরে বিগ্রহ তুলে দেওয়া হয় শিল্পীর হাতে। তিনি নতুন ক্ষুর দিয়ে বিগ্রহে আঁচড় কেটে নিজে হাতে গ্রহণ করেন। পরের পনেরো দিন বিগ্রহ শুধু শিল্পীর। পৌষের ষোলো তারিখ রাতে নির্দিষ্ট সময়ে সেবাইতরা শিল্পীকে বলেন, “আমাদের গৌর আমাদের ফিরিয়ে দাও।” নবসাজে সজ্জিত সেই বিগ্রহ ফিরিয়ে দেন শিল্পী। পরের দিন অভিষেকের পরে ফের বিগ্রহের দর্শন পাওয়া যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Artist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE