Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

বাবলুর আসল নলেন গুড়ে মজেছে দিল্লি থেকে দুবাই

মোবাইল ফোনটা কান থেকে নামিয়েও কথা থামে না মানুষটার। তিরিক্ষে মেজাজে বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘‘হুঁ, আমায় পয়সা দেখাচ্ছে! আরে বাবলু রুদ্রকে পয়সা দেখিয়ে লাভ নেই। গুড় নিতে হলে আমার সময় মতো নিতে হবে।

বাবলু রুদ্র। — নিজস্ব চিত্র

বাবলু রুদ্র। — নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:২২
Share: Save:

মোবাইল ফোনটা কান থেকে নামিয়েও কথা থামে না মানুষটার।

তিরিক্ষে মেজাজে বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘‘হুঁ, আমায় পয়সা দেখাচ্ছে! আরে বাবলু রুদ্রকে পয়সা দেখিয়ে লাভ নেই। গুড় নিতে হলে আমার সময় মতো নিতে হবে। সে তুমি হিল্লিদিল্লি যেখানকার যে লাটসাহেবই হও না কেন।’

বিড়বিড় করতে-করতেই শুকনো পাটকাঠির গোছা উনুনে ঠেসে দিলেন বাবলু। দাউদাউ আগুনে টাটকা খেজুর রস টগবগ করে উঠল। নলেনের গন্ধে ম-ম মাঘের সকাল।

বাবলু খেপে আছেন বটে, কিন্তু বাড়িয়ে কিছু বলছেন না।

নদিয়া আর বর্ধমানের সীমানায় বাবলারি গ্রামের বাবলু রুদ্রর তৈরি নলেন গুড় চাইলেই পাওয়া যায় না। নলেনের কারিগর বাবলু, তস্য পিতা কালীপদ রুদ্র, তস্য পিতা ক্ষুদিরামের গুড়ের খ্যাতি চার পুরুষের। খদ্দেরকে সামনে বসিয়ে গাছ থেকে রস নামিয়ে তার চোখের সামনে গুড় তৈরি করে দেন বাবলু।

সে গুড়ের যেমন রূপ তেমন স্বাদ-গন্ধ। সোনালি রঙের পাটালি রোদে রাখলে মোমের মতো গলে যায়। দাম অবশ্য বাজারের গুড়ের তিন গুণ। সাধারণ গুড় যেখানে ৬০-৭০ টাকা কেজি সেখানে বাবলুর গুড় বিকোয় দুই থেকে আড়াইশো টাকায়। কিন্তু রসিক খদ্দেরদের দাম নিয়ে ভাবতে বয়েই গিয়েছে।

সত্যি বলতে দুবাই থেকে দিল্লি, বেঙ্গালুরু থেকে বর্ধমান— বাবলুর নলেন গুড়ের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন বহু জন। বাবলু জানান, গোটা শীতকাল জুড়েই তিনি কুরিয়ার মারফত মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লিতে গুড় পাঠান। ক’দিন আগে প্লেনে চড়ে দুবাইও পাড়ি দিয়েছে তাঁর গুড়। ক্রেতার নাম প্রকাশ সরকার। অঘ্রান মাসের শেষে তিনি পাঁচ কেজি গুড়ের বায়না করেছিলেন। হাতে পেলেন পৌষের শেষে। জয়পুরের বাসুদেব দত্ত, মুম্বইয়ের বংশী দে, বেঙ্গালুরুর মদন দত্ত গুড়ের অর্ডার দিয়ে এখনও অপেক্ষায় রয়েছেন, কবে বাবলুর হাতের অমৃত এসে পৌঁছয়।

ইতিমধ্যেই কৃষ্ণনগর থেকে টিউবে সেঁধিয়ে বিশ্বের বাজারে রওনা দিয়েছে খেজুর গুড়। কিন্তু বাবলু যেন থাকেন পৃথিবীর উল্টো পিঠে। বাজারে তিনি ধর্না দিতে যান না, বাজার আসে তাঁর নির্জন পৃথিবীতে। এবং সেই পৃথিবীতে মানই শেষ কথা, পরিমাণ নয়।

পৌষ পেরিয়ে এই মাঘে বাংলার যে কোনও বাজারে গেলে নলেন-পাটালি দিব্যি চোখে পড়বে। কিন্তু সে সবের সঙ্গে বাবলুর গুড়ের কোনও তুলনাই চলে না। দ্রুত হাত চালাতে-চালাতেই বাবলু বলে চলেন, ‘‘এখন এই ভরা মরসুমে আমার কাছ থেকে গুড় কিনতে হলে কমপক্ষে দশ দিন অপেক্ষা করতে হবে। কী করব বলুন? আমি তো চিনি-জল মিশিয়ে কেজি-কেজি গুড় বানাই না। দিনে মেরে-কেটে পাঁচ-ছ’কেজি। অথচ লোকের চাহিদার শেষ নেই। ফলে অপেক্ষা করতেই হয়।’

কার্তিক থেকে ফাল্গুন। এই পাঁচ মাস রসের সময়। রসের ‘সওদাগর’ এ সময়ে নাওয়া-খাওয়ার সময় পান না। ভোর হতে না হতে চকচকে ‘চাঁচ দা’ বেরিয়ে পড়েন বাবলু। বাবলারি গাঁয়ের পশ্চিম পানে ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেললাইন বরাবর নদিয়ার সীমানা। লাইন পেরোলেই বর্ধমান। খেতের মধ্যে দিয়ে আল ধরে কয়েক মাইল গেলে জাহান্নগর পঞ্চায়েতের ‘দ্বীপের মাঠ’। এখানেই লুকিয়ে আছে অমৃতের ভাঁড়ার। বাবলুর বাপ-দাদার বাগানের শ’খানেক খেজুর গাছ। তা থেকে নিজেই বাছাই করে বাবলু যখন রসের কলসি পেড়ে আনছেন, তখন সবে সূর্য উঠছে। রস ছেঁকে কড়াইয়ে ঢেলে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হতে আরও ঘণ্টা চারেক। সাড়ে সাত কেজি রস থেকে বড় জোর সওয়া এক কেজি পাটালি হয়। গুড় তৈরির প্রতিটি পর্ব নিজের হাতে না করলে স্বস্তি পান না বাবলু। পুরুষানুক্রমে ঠিক যে ভাবে গুড় তৈরি করে এসেছেন তাঁর বাপ-দাদারা। অঘ্রান, পৌষ আর মাঘ— এই তিন মাসে গড়ে রোজ পঞ্চাশ কেজি রস জ্বাল দেন তিনি। কার্তিক আর ফাল্গুন মাসে ঠান্ডার তারতম্যের উপর গুড়ের পরিমাণ নির্ভর করে। যেমন এ বার তেমন শীত না পড়ায় পরিমাণে টান পড়ছে। তবে রোজকার কাজ চলছেই।

বাবলু জানান, গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় পুজোর আগে থেকেই। আশ্বিনের প্রথমে হয় খেজুরগাছ ‘ঝাড়া’। এর ছ’দিন পরে হয় ‘চাঁচ’ দেওয়া। তারও পাঁচ দিন পরে ‘চোখ’ কাটা। এর পরে অপেক্ষা গাছ কবে ‘ঘামতে’ শুরু করে তার জন্য। খেজুরগাছ ঘামলেই রসের জন্য তৈরি বলে ধরে নেওয়া হয়। শেষ কাজ ‘রেক টানা’ অর্থাৎ যে পথ দিয়ে রস বের হবে দক্ষ সার্জেনের মতো নিপুন হাতে দা দিয়ে সেই রাস্তা তৈরি করে ইঞ্চি দেড়েক লম্বা কঞ্চির ‘নলি’ বসিয়ে দেওয়া। তার পর... খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন...!

এক হাতে দা। কোমরে জড়ানো মোটা দড়ি। অন্য হাত চোখের উপরে রেখে ত্রিসন্ধে রসের খোঁজে ফিরছেন তিনি— বাবলু রুদ্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news Molasses
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE