Advertisement
০৪ মে ২০২৪

সংসার সচল রাখতে ভরসা বৃদ্ধ ও খুদেরা

নোট নিয়ে নাজেহাল তামাম দেশ। হাটে-বাজারে, বাসে-ট্রেনে খুচরো ঝামেলা লেগেই আছে। এ দিকে একশোর খোঁজে ব্যাঙ্ক, ডাকঘর ঘুরে ঘেমেনেয়ে একসা।

শুভাশিস সৈয়দ ও সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১২
Share: Save:

নোট নিয়ে নাজেহাল তামাম দেশ।

হাটে-বাজারে, বাসে-ট্রেনে খুচরো ঝামেলা লেগেই আছে। এ দিকে একশোর খোঁজে ব্যাঙ্ক, ডাকঘর ঘুরে ঘেমেনেয়ে একসা। কিন্তু নোটের দেখা নেই। দিন কয়েক আগে তোশকের নীচে জমানো টাকা গিন্নি তুলে দিয়েছিলেন বাড়ির কর্তার হাতে। এই ক’দিনে তা-ও শেষ।
এ বার?

এমন দুঃসময়ে এগিয়ে এলেন বাড়ির প্রৌঢ়, ‘‘হ্যাঁ রে খোকা, আলমারির উপরের তাকে খবরের কাগজের নীচে হাজারখানেক টাকা আছে। সব একশো। ওখান থেকে‌ নিয়ে আপাতত চালিয়ে নে। পরে কিন্তু দিয়ে দিবি।’’

রোজগেরে খোকার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কিন্তু ও দিকে আবার কর্তা-গিন্নির জোর তর্ক। ‘‘বাজারের লিস্টি এ বার ছোট করতে হবে। এত কিছু আনতে পারব না। একশো টাকা তো সব শেষ।’’ কর্তার মেজাজ তুঙ্গে। গিন্নিরও পাল্টা জবাব, ‘‘লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে ওই নোটগুলো তো আমিই দিয়েছিলাম। তাহলে থাক, বাজার করারই দরকার নেই। সবাই মিলে উপোস দিই।’’

কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে বাড়ির খুদে সদস্য। হাতে হলুদ রঙের পিগি ব্যাঙ্ক। দশ আর পাঁচ টাকার কয়েনে ভর্তি সেই ‘ব্যাঙ্ক’ বাবার হাতে তুলে নিয়ে খুদের আবদার, ‘‘বাজারে গিয়ে একটু চিকেন এনো তো। আর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পেয়ে গেলে এটা আবার ভরে দিও।’’

কৃষ্ণনগর থেকে কল্যাণী, নবদ্বীপ থেকে বহরমপুর, করিমপুর থেকে কান্দি কিংবা জলঙ্গি থেকে জঙ্গিপুর কমবেশি সর্বত্রই বাড়ির কর্ত্রীর পরে এ বার ত্রাতার ভূমিকায় বাড়ির বয়স্ক ও খুদে সদস্যরা। কৃষ্ণনগরের বিশ্বনাথ বিশ্বাস যেমন। আশি বছরের ওই বৃদ্ধে ছয় ছেলে, স্ত্রী, বৌমা, নাতি-নাতনি নিয়ে জমজমাট সংসার। ছেলেরা মাঝেমধ্যে তাঁর হাতে কিছু টাকা তুলে দেন। তিনি সেগুলো সযত্নে জমিয়ে রাখেন। কেন? হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘মরলেও তো রেহাই নেই রে বাবা। তখনও কিছু খরচা আছে। তাই যতটা পারি জমিয়ে রাখি। ছেলেরা তখন এই টাকা কাজে লাগাতে পারবে।’’

সেই বিশ্বনাথবাবু বাড়িতে বসে সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সব খবরই রাখেন। মোদীর মায়ের ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তোলা থেকে ব্যাজার মুখে নিজের ছেলের ব্যাঙ্ক থেকে খালি হাতে ফেরা, সবই তিনি দেখেন। মঙ্গলবার রাতে অনেক ভেবে শেষতক সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন তিনি। পরের দিন সকালে সেজ বৌমা অনিতাদেবীকে ডেকে তিনি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন টিনের কৌটোর মধ্যে ভাঁজ করে রাখা আড়াই হাজার টাকা। একশো, পঞ্চাশ আর দশ টাকার নোট।

অনিতাদেবী বলছেন, ‘‘এই অসময়ে বাবার দেওয়া টাকাটা খুবই কাজে দিল। আমরাও বাবাকে কথা দিয়েছি, নোটের সমস্যা মিটে গেলে ওঁকে এই টাকাটা ফিরিয়ে দেব।’’ হাসছেন বিশ্বনাথবাবু, ‘‘ধার-বাকির থেকেও বড় কথা হল ছোট ছোট সঞ্চয়। আমি মরার চিন্তা করে টাকা জমাচ্ছিলাম। সেটাই এ যাত্রা সব্বাইকে বাঁচিয়ে দিল। এটা ভেবেই ভাল লাগছে।’’

কৃষ্ণনগরের বছর বাহাত্তরের প্রতিভা সরকার ছেলের কাছে থাকেন। তিন মেয়ে বেড়াতে এলেই তাঁর হাতে জোর করে কিছু না কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে যান। সেই টাকা তিনি রেখে দেন ঠাকুরঘরের সিংহাসনের পাশে রাখা একটি বইয়ের ভাঁজে। খুচরোর এই আকালে তিনি সেখান থেকে বেশ কিছু টাকা তুলে দিয়েছেন ছেলের হাতে। প্রতিভাদেবী বলছেন, ‘‘ব্যাঙ্কে সকলেরই কমবেশি টাকা আছে। কিন্তু প্রয়োজনে যদি সে টাকা না পাওয়া গেলে তার আবার মূল্য কী!’’

সংসারের চাকা সচল রাখতে পিছিয়ে নেই খুদেরাও। পুজোয় মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দুশো টাকা পেয়েছিল শান্তিপুরের প্রণয় দে। অষ্টম শ্রেণির ওই পড়ুয়া সে টাকা রেখে দিয়েছিল বইয়ের তাকে। বাবার অফিস যাওয়ার সময় খুচরো নোটের আকাল পড়তেই সে টাকা সে তুলে দিয়েছে বাবার হাতে।

প্রতি দিন সকালে ট্রেন ধরার তাড়া থাকে বহরমপুরের স্বাস্থ্যকর্মী সোমা বিশ্বাসের। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগ খুলে দেখেন তাঁর কাছে যা আছে সব বড় টাকার নোট। একশো, পঞ্চাশ কিচ্ছু নেই। ফোন করে এক সহযাত্রীকে তিনি ট্রেনের টিকিট কেটে রাখার অনুরোধ করছিলেন। ঠিক সেই সময়ে পিগি বক্স হাতে গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সোমাদেবীর একরত্তি মেয়ে রাগিনী, ‘‘তোমার নোট তো অচল হয়ে গিয়েছে। তুমি কি আমার থেকে খুচরো নেবে!’’

প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সোমাদেবী। যে মেয়ে কাউকে তার পিগি বক্সে হাত দিতে দেয় না, সে কি না নিজে থেকেই টাকা দিচ্ছে! মেয়েকে আদর করে তার পিগি বক্স থেকে খুচরো কিছু টাকা নিয়ে অফিস রওনা দেন। নিত্যযাত্রীদের আলোচনায় কান পাতলে এমন অনেক রাগিনী, প্রণয়, বিশ্বনাথদের কথা উঠে আসছে।

ভাগ্যিস লক্ষ্মীর ভাঁড়, পিগি বক্স, বইয়ের ভাঁজ, বালিশ কিংবা তোশকের ভিতরে এখনও এমন মুশকিল আসান লুকিয়ে থাকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Piggy bank expenditure
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE