Advertisement
০৫ মে ২০২৪

রাত থেকে রাতে বদলে যায় ধাবা

ঝিঁঝিঁদের কনসার্ট থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। শ্রাবণ রাতে টিনের চালে বৃষ্টিকুচি। হাইওয়ে দিয়ে সশব্দে ছুটে চলেছে দূর-পাল্লার ট্রাক। তরকার ঝাঁঝ, কষা মাংসের গন্ধ, ডিমের ভুজিয়া ছাপিয়ে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে মদের গন্ধ। বিয়ার-বাংলা, দিশি-বিদেশি মিলেমিশে একাকার।

হাইওয়ে ধরে ছুটতে থাকা ট্রাক ঠিক থেমে যায় তার সামনে— ঘন তরকা-রুটি-কষা মাংস আর... রাতের তারার মতো জ্বলে ওঠে দেহপসারিণী, পুলিশ-চালক-শহর ক্লান্ত মানুষ সবাই আত্মসমর্পণ করে তার কাছে— রাতের ধাবার চেয়ার টেনে বসলেন সুস্মিত হালদার আর শুভাশিস সৈয়দ।

হাইওয়ে ধরে ছুটতে থাকা ট্রাক ঠিক থেমে যায় তার সামনে— ঘন তরকা-রুটি-কষা মাংস আর... রাতের তারার মতো জ্বলে ওঠে দেহপসারিণী, পুলিশ-চালক-শহর ক্লান্ত মানুষ সবাই আত্মসমর্পণ করে তার কাছে— রাতের ধাবার চেয়ার টেনে বসলেন সুস্মিত হালদার আর শুভাশিস সৈয়দ।

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০২:১৫
Share: Save:

ঝিঁঝিঁদের কনসার্ট থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। শ্রাবণ রাতে টিনের চালে বৃষ্টিকুচি। হাইওয়ে দিয়ে সশব্দে ছুটে চলেছে দূর-পাল্লার ট্রাক।

তরকার ঝাঁঝ, কষা মাংসের গন্ধ, ডিমের ভুজিয়া ছাপিয়ে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে মদের গন্ধ। বিয়ার-বাংলা, দিশি-বিদেশি মিলেমিশে একাকার। কৃষ্ণনগর শহর ঘেঁষা বাহাদুরপুর ফরেস্টের উল্টো দিকে রাতের ধাবা জুড়ে যেন আবগারি আবহ।

কোণের বেঞ্চে একের পর এক উড়ে যাচ্ছে দিশির গেলাস। কাঠের তক্তার উপরে সশব্দে ফাঁকা গেলাস রেখে মধ্য চল্লিশের চালক হাঁক পাড়ছেন, ‘‘কই রে, আর একটা হাফ দে। সঙ্গে কড়া করে দু’টো রুটি।’’ তারপর জড়ানো গলায় গুনগুনিয়ে উঠলেন, ‘‘আজা আয়ি বাহার...দিল হ্যায়...।’’

বৃষ্টি ধরে এসেছে। দূরে পাটখেত, মোবাইল টাওয়ারের উপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। টলমল পায়ে ছুটে চলেছে ঘড়ির কাঁটা। নেশা বাড়ছে রাতেরও। টলতে টলতে বেঞ্চ ছেড়ে সেই চালক এগিয়ে গেলেন ধাবার হেঁশেলের দিকে। চোখের ইশারা শেষ হতেই রাঁধুনি পাশের দেওয়ালের ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে গলাটা খাদে নামিয়ে হাঁক দিলেন—‘হ্যালো...এই হ্যালো....।’

চওড়া হাসি নিয়ে হাজির হ্যালো। আজ রাতে এটাই তাঁর নাম। লাল-হলুদ চুড়িদার। টকটকে সিঁদুরের টিপ। মৃদু স্বরে কিছু কথাবার্তা, হাসি। তারপর ডুমের আলো থেকে হারিয়ে যাওয়া নিকষ অন্ধকারে। রাত সোয়া এগারোটা। পাশের খাটিয়া থেকে এক যুবক বলে উঠলেন, ‘‘এই তো সবে সন্ধ্যা হল। খেলা এখনও বাকি। তা দাদারা এখানে নতুন নাকি?’’

বাড়ছে রাত। জেগে রয়েছে ধাবা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি ধাবা রয়েছে। তবে ভিড় বেশি এখানেই। কেন? স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘‘হবে না? মদ তো আছেই। সন্ধ্যার পরে আনাগোনা শুরু হয় মহিলাদেরও। সবই তো বোঝেন!’’ পুলিশ কখনও কড়া কখনও নরম!

নবগ্রামের পলসণ্ডা মোড়ের ধাবাটায় পুলিশের সাদা বোলেরো থেকেই নেমে আসেন রাতের ‘হ্যালো’, ‘কাজল’ আর ম্যজেন্টা সালোয়ারের ‘নৌরিন’ (ওই নামেই তাঁদের ডাকছিলেন সঙ্গীরা)। বৃষ্টি আর ধুলোর আড়ালে গাড়ির ‘পুলিশ’ স্টিকার কবেই আবছা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধুই ‘কাওতালি।’

লাজুক হেসে ধাবা মালিক বলছেন, ‘‘এটা একটা চাকার মতো দাদা! ধাবায় যাতে হুজ্জুত না হয় তা দেখে পুলিশ। বিনিময়ে পুলিশ কর্মীরা একটু স্ফূর্তি করেন। পুলিশ খুশি আমাদেরও স্বস্তি!’’

দূরদুরান্তের ট্রাক চালক আর অন্ধকারে ঝকমকে পোশাকে তারা হয়ে জ্বলে থাকা সেই সব অভাবগ্রস্থ মহিলা— তাঁরাও বুঝি এই রাতের ধাবাতেই পরস্পরের কাছে কিঞ্চিৎ স্বস্তি খোঁজেন। রকমটাই যা ভিন্ন।

হুশ করে জ্বলেই নিভে যাচ্ছে ছুটন্ত গাড়ি। দুদ্দাড় করে একটা মোটরবাইক এসে থামে। নিজেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে জলপাই প্যান্ট পরা এক যুবক ধাবা মালিককে জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আমি ফৌজি, কোনও সমস্যা হলে আমায় বলবি!’’

হ্যাঁ ডিউটি ফাঁকা সীমান্তরক্ষীদেরও দেখা মেলে বহরমপুর ঘেঁষা রাতের ধাবায়। ধাবার মালিক ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পরিবার থেকে দূরে পড়ে থাকা, সারা দিন রোদে-জলে নিয়মে বাঁধা মানুষগুলো যাবেনই বা কোথায়!’’ তাঁর গলায় রাতের অনুকম্পা!

জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কারণে ধাবাগুলো রাস্তা থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে। সারা দিনে ২৫-৩০ কেজি আটা থেকে রুটি তৈরি হয়। চালু ওই ধাবার বিশাল মেজেতে এক সঙ্গে গোটা পঞ্চাশ জন বসে থেতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সে জন্য পেতে রাখা হয়েছে পর পর বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার। সেখানেই চলছে মদের আসর।

লাইসেন্স ছাড়াই এ ভাবে মদ বিক্রি করছেন। কোনও অসুবিধা হয় না? বহরমপুরের বলরামপুরের এক ধাবার ম্যানেজার হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘এটা কোনও কথা হল? পুলিশের সঙ্গে সেটিং আছে না!’’

ধাবায় বানানো চায়ের স্বাদই নাকি আলাদা। অনেক শৌখিনবাবু আবার তাই গাড়ি হাঁকিয়ে চায়ের টানেই চলে আসেন শহর ঘেঁষা ধাবায়। জোনাকি জ্বলা ধান খেতের দিকে তাকিয়ে থেকে কৃষ্ণনগরের তেমনই এক শৌখিন যুবক বলছেন, ‘‘আর কিছু না, বড় ভাল লাগে জানেন, চুপচাপ বসে থাকতে।’’

ছেলেটি বসে থাকে, জোনাকি, বৃষ্টি, ছুটন্ত গাড়ি যে যার নিয়মে সচল থাকে। আর রাতের ধাবা তার দিনযাপন নিয়ে রাত থেকে রাতে গড়িয়ে যেতে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dhaba
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE