দিনের বেলাতেও আলো না জ্বালিয়ে উপায় নেই। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
সরু গলি। মেরেকেটে দশ ফুট চওড়া। কৃষ্ণনগরের অন্যতম প্রাচীন গোয়াড়ি বাজারের একমাত্র প্রবেশপথ। পথ অবশ্য থেকেও নেই। রাস্তা দখল করে সব্জিপাতি নিয়ে বসে পড়েছে বাজার।
‘‘এই রাস্তা দিয়ে দমকলের ইঞ্জিন! পাগল হলেন নাকি। একটা মালবোঝাই গাড়ি পর্যন্ত ঢুকতে পারে না!’’ — বাজারে মুখে একটা জটলা তৈরি হয়েছিল। জোর আলোচনা চলছিল সেখানে। আগুনের প্রসঙ্গ উঠতেই প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন থলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি।
দিন কয়েক আগের ঘটনা। বাড়ির ছাদে রান্না বসানো হয়েছিল। উনুনের সেই আগুন থেকেই চাপড়ার তালুকহুদা গ্রামের পাশাপাশি আটটি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দমকল এসেও লাভ হয়নি। আগুন নিভেছে বটে, কিন্তু ঘর বাঁচেনি। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার গোটা একটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আগুনে। পোড়া ঘর-আধপোড়া ভাতের হাঁড়ি-সন্তান হারানোর কান্না, সংবাদপত্রে পড়ে শিউরে উঠেছে মানুষ। তবু অন্যত্র ছবি বদলায়নি। বরং ‘আগুন লাগলে, দেখা যাবে’ এমন চিন্তা আঁকড়েই বসে রয়েছে সবাই। জানাচ্ছেন, প্রতিদিন গোয়াড়ি বাজারে আসা স্থানীয় লোকজন।
এক সময়ে জলঙ্গী নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল গোলাপট্টি এলাকা। বড় বড় নৌকা এসে থামতো ঘাটে। নৌকার সমগ্রী রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল বিশাল গোলা (বা গুদাম)। লোকমুখে শোনা যায়, সেই থেকে এলাকার নাম গোলাপট্টি। বানিজ্যের কাজে মানুষের ভিড় হতে শুরু করে। সেই সময়ই শহরের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী
জহর দাস সকলের সুবিধার জন্য তৈরি করছিলেন এই বাজার।
যাতে একই ছাদের তলায় নানা রকম জিনিষ বেচাকেনা করতে পারেন সকলে। সেই শুরু। পরে একটু একটু করে বাজারে পরিধি বেরেছে। বেড়েছে দোকানের সংখ্যাও। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাজারের মালিকের সংখ্যাও।
অথচ এত পুরনো একটা বাজারে নিত্যদিন আসা হাজারো মানুষের কোনও নিরাপত্তা নেই, আক্ষেপ মানুষের। গোটা বাজারটা একাধিক খন্ডে বিভক্ত। এক-এক মালিক এক-এক রকম ভাবে তাঁর নিজের এলাকা সাজিয়ে নিয়েছে। কোনও কোনও অংশের মালিক উদ্যোগী হয়ে নিজের এলাকাটুকু সংস্কার করে নিয়েছেন। তাঁর পাশের দোকানটা হয়তো যেমন কে তেমনই পড়ে রয়েছে। ফলে বাজারের ভিতরে কিছুটা অংশ নতুন কংক্রিটের তো পাশের এক ফালি এলাকা বাঁশের কাঠামোর উপরে কালো তার্পোলিন দিয়ে ঢাকা। কিছু এলাকায় বাঁশের কাঠামোর উপরে টিনের চাল তো পাশের অংশে পুরনো সুড়কি ঝরে পড়া দেওয়াল। ভাঙাচোরা ইটের দেওয়ালে মাকড়সার মতো জাল বুনে চলেছে বিদ্যুতের তার। বৃষ্টি হলে চুঁইয়ে পড়ে জল। ফলে শর্ট সার্কিটের আশঙ্কা প্রবল।
এতো গেল বাজারের ছবি। চলার পথও দুর্বিসহ। ভাল করে হাঁটাই দায়। পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকে সব্জি অথবা মাছের পসরা। দু’টো মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে গেলে ধাক্কা অবধারিত। ঘিঞ্জি বাজারের চায়ের দোকানের সামনে আরও ভিড়। চায়ের ভাড়ে ঝড় ওঠে নিত্যদিন। আর দোকানের ভিতরে গনগনে আঁচে চলছে রান্না। শিঙারা, কচুরি, মিষ্টি...। সে আড্ডায় হয়তো ঘুরে ফিরে আসে চাপড়ার আগুনের কথাও। কিন্তু কারও মাথায় আসে না নিজেদের বাজারটার কথা।
প্রতি দিন সকালে এই গোয়াড়ি বাজারেই থলি হাতে চলে আসেন সুবীর সিংহ রায়। বললেন, ‘‘ভাবুন একবার। গোটা বাজারটাই একটা জতুগৃহ হয়ে আছে। আগুন লাগার সমস্ত উপকরণ মজুত। আগুন লাগলে নেভানোর জন্য জলের ব্যবস্থাও নেই। মানুষ পালানোর পথ পাবে না।’’
ক্রেতাদের সঙ্গে সহমত ব্যবসায়ীরাও। কাপড়ের ব্যবসায়ী উৎপল নাথের কথায়, ‘‘কোনও কারণে আগুন লাগলে আর রক্ষা নেই। দমকলের ইঞ্জিন ঢুকবে কী করে জানি না। তার থেকেও বড় কথা, আগুন লাগলে মানুষ বেরবে কোন পথে?’’ নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা দোকানে রাস্তা ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। সারানোরও বালাই নেই, ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুঁকছে দোকানপাট। ‘‘গোটা বাজারটাই ঢেলে সাজানোর দরকার। কিন্তু মালিকদের বলেও কোন লাভ হয়নি,’’ বললেন উৎপলবাবু।
বাজারের ভিতরে বেশ কিছুটা অংশের মালিকানা বাজার কমিটির। বছর দুয়েক আগে নিজেদের টাকায় তারা সেই অংশটুকু কংক্রিটের করে নিয়েছেন। প্রশ্ন করতেই কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক অসীম দত্ত বললেন, ‘‘আমরা আমাদের অংশটুকু তো পাকা করে নিয়েছি।’’ আর বাকিটা? ‘‘গোয়াড়ি বাজারের তো এখন অনেক মালিক। কেউই কখনও একমত হয় না। পুরসভাও বাজারের বর্তমান অবস্থা দেখে কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটাও তো হল না। বাধ্য হয়েই তাই আমরা আমাদের অংশটুকু সারিয়ে নিয়েছে। আর এই বিপজ্জনক আবস্থার ভিতরেই ব্যবসা করছি,’’ বললেন অসীমবাবু।
এই ‘আমার-ওঁর’ অবস্থা বাজারের মালিকদের অন্যতম অমল দাসেরও। বললেন, ‘‘আমি তো আমার অংশটুকু পুরসভার কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাকি মালিকরা তো একমত হতে পারল না। ব্যধ্য হয়ে আমি আমার অংশের বিপজ্জনক জায়গাটুকু ভেঙে দিয়েছি।’’
কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বললেন, ‘‘আগুন লাগলে ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে। ভাবলেই শিউরে উঠি।’’ তা হলে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? ‘‘কে বলেছে নিইনি। একাধিকবার বাজারটা আমরা অধিগ্রহণ করতে চেয়েছি। মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিন্তু ওই বাজারের এখন প্রচুর মালিক। তারা কেউই একমত হতে পারছেন না। ফলে আমরা কিছুই করতে পারছি না,’’ বলছেন তিনি।
গোটা বিষয়টিতে বেজায় ক্ষুব্ধ দমকল। তাদের কথায়, ‘‘এমনিতেই রাস্তা সরু। তা-ও বেদখল হয়ে। ইঞ্চিন ঢোকার কোন উপায় নেই।’’ আর জলের ব্যবস্থা? না। তেমন কোনও ব্যবস্থাও নেই। পুকুর তো নেই। জলঙ্গী নদী থাকলেও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। খবর পেয়ে দমকল বাহিনী আসার পরে জলঙ্গী নদী পর্যন্ত পাইপ নিয়ে যেতে যেতে বাজারের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, আশঙ্কা দমকল কর্মীদের।
তাদের আরও অভিযোগ, আগুনের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বাজারের নিজস্ব কোনও ব্যবস্থাও নেই। গোটা বাজার ঘুরেও একটা অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার বা বালি ভর্তি বালতির দেখা মেলে না।
তা হলে কি এই অবস্থাতেই পড়ে থাকবে গোয়াড়িবাজার? ভবিষ্যতে বড়সড় কোন দুর্ঘটনার অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন সকলে? কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা শাসক মৈত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তাভাবনা করছি। বাজারের মালিকদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান সূত্র বের করতে হবে।’’ কিন্তু কবে? উত্তরের অপেক্ষায় সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy