শহরের গোরাবাজার, বাসস্ট্যান্ড, নিমতলা মোড়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলে-বুড়ো-খুকুর দল। কারও হাতে অ্যালুমিনিয়েমের গামলা। কারও হাতে পিতল বাটি। কেউ আবার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তর সইছে না কারও। হাঁড়ির ফাঁক গলগল করে উঠছে ধোঁয়া। কুয়াশার চাদরে সে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা ছাড়িয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে দোকানির দিকে বাড়ানো পাত্র, হাতের তালুতে ধরা কাগজ ভরে যায় গরম ধুকিতে। কেউ সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরম ধুকি মুখে পুরে নেন। কেউ বা বাড়িতে গিয়ে আয়েশ করে চাখেন সুস্বাদু ধুকি।
শীত কালেই ধুকির দেখা মেলে। আবার শীত ফুরোলে ধুকিও হাওয়া। আদ্দি কালে ঠাকুমা-দিদিমারা বাড়িতে ধুকি বানাতেন। স্বাদের গুণে সেই ধুকি এখন বিকোয় পাড়ার মোড়ে, গলিতে। দেখতে অনেকটা গোল ভাপা পিঠের মতো। বানাতে লাগে আতপ চালের গুঁড়ো আর এট্টুখানি গুড়। ব্যাস!
বহরমপুর বাস টার্মিনাস এলাকার ধুকি বিক্রেতা মলিনা সাহা বলেন, ‘‘রাতে ঘণ্টা তিনেক আতপ চাল ভিজিয়ে রাখি। ভোরে শিলনোড়ায় তা গুঁড়ো করে নিয়ে বাস টার্মিনাস চলে আসি।’’ পরিমাণে বেশি হলে ভেজা চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা হয়। ছোট্ট উনুনের উপর বসানো থাকে অর্ধেকটা জলে ভরা হাঁড়ি। সেই হাঁড়ির ঢাকনার মাঝখানে ছোট্ট একটি ফুটো রাখা হয়। স্টিলের একটি ছোট বাটিতে চাল গুঁড়ো ভরে তার মাঝে আখের গুড় অথবা নলেন গুড়ের পুর দেওয়া হয়। তারপর কাপড়ে মুড়িয়ে সেই বাটি সেই ছোট ফুটোর উপর রাখা হয়। কেউ আবার মাটির তৈরি সরা ব্যবহার করেন। দু’তিন মিনিট গেলেই তৈরি ইডলির মতো নরম তুলতুলে ধুকি।
ধুকির প্রথম কোথায় বানানো হয়েছিল সে নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। অনেক গল্পগাছাও রয়েছে ধুকিকে ঘিরে।
বহরমপুর শহরের বাস টার্মিনাস থেকে শুরু করে দক্ষিণে গোরাবাজার এলাকায় ধুকির প্রচলন বেশি। গোরাবাজারের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব এক বিড়ি শ্রমিক বলেন, ‘‘আদতে শহর ছিল উত্তর প্রান্তে। ইংরেজ দেশ শাসনের সময় শহরের দক্ষিণপ্রান্তে গোরাদের ও তাঁদের পরিষেবার জন্য প্রদেশ থেকে আসা চাকরবাকরদের জন্য বাজার ও বসতি গড়ল। নাম হল গোরাবাজার। বাপ ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি, সেখান থেকে ধুকির আমদানি।’’
নবান্নের পরেই চলে পিঠেপার্বণ। এখনও রাঢ় এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ধুকি উৎসব হয়। ধুকির সঙ্গে থাকে খাসি, হাঁস, মুরগির মাংসের ঝোলও। আয়তন অনুসারে বর্তমানে বহরমপুর শহরে ধুকির বাজার দর এটা ১ থেকে ৫ টাকা।’’ ঝালে-ঝোলে না হোক, খালি মুখে ধুকি চাখছেন অনেকে। এ সময়, ধুকিরই সময়।
নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy