Advertisement
১৭ মে ২০২৪

আরব দেশে রুজির ফাঁদে

ঝকঝকে অফিস। কাচের টেবিলে গ্লোব, ল্যাপটপ। রিভলভিং চেয়ারে দুলছেন সংস্থার কর্তা।পাশে কম্পিউটার আর প্রিন্টারে সাজানো ঘর। বাইরে ঢাউস ফ্লেক্সে লেখা ‘এমবি এন্টারপ্রাইজ’। তাতে মস্ত বড় বিমানের ছবি।

অভিযোগের পরে ডোমকলে তালাবন্ধ অফিস। — নিজস্ব চিত্র

অভিযোগের পরে ডোমকলে তালাবন্ধ অফিস। — নিজস্ব চিত্র

সুজাউদ্দিন ও সুস্মিত হালদার
ডোমকল ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৬ ০১:৩৬
Share: Save:

ঝকঝকে অফিস। কাচের টেবিলে গ্লোব, ল্যাপটপ। রিভলভিং চেয়ারে দুলছেন সংস্থার কর্তা।

পাশে কম্পিউটার আর প্রিন্টারে সাজানো ঘর। বাইরে ঢাউস ফ্লেক্সে লেখা ‘এমবি এন্টারপ্রাইজ’। তাতে মস্ত বড় বিমানের ছবি।

অফিসের ঠিক বাইরেটায় কর্তার শাগরেদ চোখ নাচিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দেখছেন কী? ওই উড়োজাহাজে চড়েই আপনারা দুবাই যাবেন।’’

দেখে-শুনে চকচক করে উঠেছিল জলঙ্গি, রানিনগর ও ডোমকল থেকে আসা যুবকদের চোখ। কিন্তু অন্ধকার নামতেও দেরি হয়নি। কেউ ফিরেছেন প্রাণ হাতে করে, ভুয়ো ভিসার ফেরে পড়ে কারও পাড়িই দেওয়ায় হয়নি।

ডোমকলে এ রকমই একটি ভুয়ো এজেন্সির অফিসে এসে বহু যুবক প্রতারিত হয়েছেন। সংস্থার কর্তা আলি হাসান বিশ্বাস ওরফে হাফিজ সাহেবের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে। যদিও তিনি আপাতত নাগালের বাইরে। সম্ভবত দুবাইয়ে।

এই হাফিজ সাহেবের হাত ধরে একটা সময়ে বেশ কিছু যুবক আরব দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। রোজগারও করেছেন। তাই ভাল বাজারও তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর সংস্থার। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ।

জলঙ্গির কাটাবাড়ি পঞ্চায়েতের গোবিন্দপুর গ্রামের টুটুল মণ্ডলের খেদ, ‘‘বৌ-মেয়ের গয়না, শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া মোটরবাইক বিক্রি করে ডোমকলের অফিসে বসে নগদ দেড় লক্ষ টাকা গুনে দিয়েছিলাম। ওরা বলেছিল, ঠান্ডা ঘরে বসে দিনে আট ঘণ্টা খাটলেই মাসে ২৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। বাড়তি পরিশ্রম করলে আরও বেশি। কিন্তু গিয়ে বুঝি, আমরা ফেঁসে গিয়েছি।’’

নটিয়ালের সাইদুল, বামনাবাদের আসরাফ ও ডোমকলের নাখেরাজ এলাকার রাজু শেখের অভিযোগ, ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল, বিমানবন্দর এসে ‘কোম্পানির লোক’ নিয়ে যাবে। কিন্তু দুবাই পৌঁছে দেখেন, কেউ নিতে আসেনি। শেষে এক বাঙালির সাহায্যে একটা বাড়ির অব্যবহৃত বাথরুমে ক’দিন কাটিয়ে বাড়িতে ফোন করে টিকিট কাটিয়ে দেশে ফেরেন। অনেকেরই টিকিটের পয়সা জোটেনি। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে সেই টিকিট কেটে দিয়েছে।

সে সব বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন সাইদুল— ‘‘ভাল রোজগারের আশায় জমি লিজ দিয়ে দুবাই গিয়েছিলাম। দেড় লক্ষ টাকা খরচ। সেখানে এক বাঙালি আমাদের ভিসা দেখে চমকে ওঠেন। তাঁর কাছেই প্রথম জানতে পারি, আমাদের বেড়ানোর ভিসা দেওয়া হয়েছে। দিন কয়েক পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে পচতে হবে। আবার জমি লিজ দিয়ে বিমানের টিকিট করে ফিরি।’’

অনেকটা একই ছবি নদিয়াতেও।

বাড়ির ফোন পেলেই ঝরঝর করে কাঁদছেন ঘুঘড়াগাছির অজয় মণ্ডল। বলছেন, “যেমন করে হোক আমাকে তোমরা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।” যে টাকা দেওয়ার কথা বলে তাঁকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কম টাকা দেওয়া হচ্ছে। অজয় কিন্তু এর আগেও সৌদি আরবে গিয়েছেন। তাঁর দাদা বিজয় বলেন, “প্রথম বার ঠিকঠাক ছিল। এ বার ডাহা ঠকে গিয়েছে।”

এটা সত্যিই যে নদিয়ার নানা প্রান্ত থেকে কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, বাহরিন, সিরিয়ায় গিয়ে কাজ করে আগে হাজার হাজার টাকা বাড়ি পাঠিয়েছেন অনেকে। নতুন বাড়ি, মোটরবাইক, ব্যাঙ্কে টাকা জমেছে। কিন্তু এখন ছবি অন্য।

মাস কয়েক আগে ফুলিয়ার রাজু দেবনাথকে বাহরিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাঠের মিস্ত্রির কাজ দেওয়া হবে বলে। দেওয়া হয় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ। কান্নাকাটি জুড়ে দেন তিনি। নবান্নের দ্বারস্থ হন তাঁর মা। বোতল তৈরির কারখানায় কাজ দেবে বলে নিয়ে গিয়ে ইছাব শেখকে গবাদি পশু চরাতে লাগানো হয়েছিল। তিনি ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।

নদিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে যান বগুলার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে। অনেক সময়ে মাইকে প্রচার করে ‘ইন্টারভিউ’ নিয়ে বিদেশে লোক পাঠানো হয়। আসেন সংশ্লিষ্ট দেশের লোকজন। আবার দালালেরাও গ্রাম থেকে লোক জোগাড় করে পাঠায়। ৫০-৬০ হাজার টাকা করে নেয়। বগুলা-১ পঞ্চায়েতের প্রধান দুলাল বিশ্বাস বলেন, “প্রায়ই আমার কাছে লোকজন আসেন যাঁরা বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।” কেন?

প্রায় ২০ বছর ধরে বিদেশে লোক পাঠাচ্ছেন সমর বিশ্বাস। তাঁর মতে, “মুশকিল হয়েছে বেশ কিছু ভুয়ো সংস্থা তৈরি হয়ে যাওয়ায়। তাদের দালালেরা গ্রামেগ়ঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” শান্তিপুরের মানিক শেখের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন রাজু দেবনাথের মা। মানিকের দাবি, “কিছু মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু অনেকেই আবার রোজগারের আশায় বিদেশ গিয়েও দরকার মতো পরিশ্রম করতে পারছেন না। দেশে ফিরে আসতে চাইছেন।”

ডোমকলের হাফিজ সাহেবের শাগরেদ গোলাম মোস্তফারও একই সুর— ‘‘ভিন্ দেশে গিয়ে কেউ বসে খাওয়াবে? পরিশ্রম করলে তবেই তো পয়সা পাবে!’’ তাঁর দাবি, হাফিজের সঙ্গে দুবাইয়ের ‘কোম্পানি’ বেইমানি করেছে। তাতেই সমস্যা হয়েছে। ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আরব দুনিয়ায় এ ভাবেই কাজ চলে। কোম্পানির হাতে পড়ে গেলে ওরা সব সামলে নেয়।’’

আপাতত অবশ্য বেসামাল! হাফিজ সাহেবের অফিসে পড়েছে তালা। পুলিশের খবর, অভিযোগ হাতে আসার পরে তদন্ত শুরু হয়েছে।

যদিও তাতে কতটা কী হবে, খোদায় মালুম!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Visa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE